মোস্তফা রনি, জন্ম বেড়ে ওঠা রাজধানীর মগবাজারে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে মোস্তফা রনি বড়। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে সংসার সামলানোর দায়িত্ব কাঁধে ওঠে ছোট্ট মোস্তফার। প্রথমে কারওয়ান বাজারে দিন মজুরের কাজ করতো ছোট্ট মোস্তফা। এরপর ১৯৯৯ সালে সৌদি আরবে যান। সেখান থেকে পাড়ি জমান দুবাইয়ে।

নিজের সঞ্চয়, দেশে মা-বোনের কাছে পাঠানো টাকা ফেরত নিয়ে এবং উচ্চ সুদের ঋণের টাকায় ‘জেটি মেট্রো’তে শ্রমিক সরবরাহের কাজে ব্যস্ত মোস্তফার সেখানে কেটে যায় সাতবছর। স্বপ্নে বিভোর মোস্তফা ভুলেই গিয়েছিলেন দুবাইয়ে তার ভিসার মেয়াদ শেষ। ভিসা জটিলতায় দুবাই সরকার ২০০৭ সালে মোস্তফাকে দেশে ফেরত পাঠায়।

দেশে ফিরে প্রথমে কাকরাইল মসজিদের সামনে আতর বিক্রির কাজ শুরু করেন। বাজার খরচ, অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা তো দূরের কথা, বাচ্চার দুধ কেনার সামর্থ্যও ছিল না তখন।

২০০৯ সালের ৫ জুলাই মগবাজারের স্থানীয় লোকজনের মুখে মোস্তফার এই দুর্দশার কথা শুনে ঢাকা-১২ আসনের সংসদ সদস্য বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তার বাসায় ডাকেন। মোস্তফাকে একটি ভ্যানগাড়ি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সহধর্মিনী হাতে তুলে দেন নগদ ১৬ হাজার টাকা। সেখান থেকেই চেষ্টা ও ওপরে ওঠা শুরু মোস্তফার।

১৬ হাজার টাকায় পুরাতন একটি ফ্লোর ক্লিনিং মেশিন কেনেন মোস্তফা। সেই মেশিন নিয়ে গুলশান-বনানী এলাকায় ভ্যান চালিয়ে দ্বারে দ্বারে অনুরোধ করে কার্পেট, সোফা, ফ্লোর, টয়লেট, গ্লাস, কিচেন ক্লিনিং ও পেস্ট কন্ট্রোলের কাজ করতে থাকেন মোস্তফা।

এক ব্যবসায়ী মোস্তফাকে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ৩২ তলা ভবনের আউট সাইড গ্লাস ক্লিনিংয়ের কাজ দেন। মোস্তফা সেই কাজকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। সেই থেকে শুরু। আগ্রাবাদের ৩২ তলা ভবনের কাজে মোস্তফা পারিশ্রমিক পান দশ লাখ টাকা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মোস্তফাকে।

একটি ভ্যানগাড়ি আর মাত্র ১৬ হাজার টাকার পুঁজিতে শুরু করা মোস্তফা খোলেন ‘পাওয়ার প্রোপার্টি কেয়ার সার্ভিস লিমিটেড’।

তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল ফারুক বলেন, মোস্তফার স্বপ্ন পূরণের লড়াই, লেগে থাকা সংগ্রাম আর অদম্য স্পৃহা কাছে থেকে দেখেছি, শুনেছি। ২০২২ সালের ১৬ মার্চ বিকেল পাঁচটায় মোস্তফার স্বপ্ন পূরণের দিন। সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উদ্বোধন করেন মোস্তফার অফিস। সেদিন আমি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মোস্তফা ও তার সহকর্মীদের কর্মতৎপরতা বিস্ময় প্রকাশ করে মোস্তফার উদ্যম ও কর্তব্যনিষ্ঠাকে নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস বলে উল্লেখ করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যে মোস্তফার পুঁজি বলতে ছিল মন্ত্রীর দেওয়া ভ্যানগাড়ি ও তার সহধর্মিনীর দেওয়া ১৬ হাজার টাকা।

যোগাযোগ করা হলে মোস্তফা রনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৯ সালের শেষের দিকে মগবাজারের গাবতলায় অফিসের কাজ শুরু করি। অফিস ডেকোরেশনের কাজ শেষে হতে হতে করোনা মহামারি চলে আসে। স্বপ্ন ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালই আমার অফিস উদ্বোধন করবেন। দেশে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় অফিস উদ্বোধন করা হয়নি।

মোস্তফার বলেন, যার দেওয়া ভ্যানগাড়ি ও টাকায় আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছে, তার পদধূলি পড়ার আগে সেই অফিসের চেয়ারে বসি কি করে! অবশেষে গত বছরের ১৬ মার্চ সেটি উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

বাবার মৃত্যুর পর নিজের জীবনের কষ্টগাঁথা তুলে ধরে মোস্তফা বলেন, ছোট দুই বোন ও অসুস্থ মায়ের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে প্রথমে আমি কাওরান বাজারে ভোর থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ডাবের আড়তে কাজ করেছি। মাসে বেতন পাওয়া আট হাজার টাকা সোজা তুলে দিতাম মায়ের হাতে। মায়ের চিকিৎসা ও দুই বোনের পড়াশোনাসহ সংসারের যাবতীয় খরচ এই টাকাতেই চলতো। কিন্তু তাতে সংসারের ঘানি টানা ছিল কষ্টকর। সেই থেকে শ্বশুরবাড়ি ও পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া কিঞ্চিৎ জমি বিক্রি করে ও কয়েক লাখ টাকা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ১৯৯৯ সালে সৌদি আরবে যাই। সেখানে ক্লিনার হিসেবে দুই বছর কাজ করেছি। ঋণ শোধের পর জমানো টাকায় বিয়েও দিয়েছি ছোট এক বোনকে। 

তিনি বলেন, সৌদি থেকে দুবাইয়ে পাড়ি জমাই বেশি বেতনে। সেখানে একটি সরকারি অফিসে অফিস বয়ের কাজ নেই। সেখানেই কেটে যায় সাতবছর। এরপর কাজ পাই জাপানি প্রতিষ্ঠান জেটি মেট্রোতে। যেখানে ২৫০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক সরবরাহের কাজ পাই। জেটি মেট্রো ঘণ্টা প্রতি একজন শ্রমিকের মজুরি ১৩ দিরহাম দিতে রাজি হয়। কিন্তু ভিসা জটিলতায় দুবাই সরকার ২০০৭ সালে দেশে ফেরত পাঠায় আমাকে। সব হারিয়ে তখন আমার পথে বসার অবস্থা। 

তিনি আরও বলেন, জীবিকার তাগিদে কাকরাইল মসজিদের সামনে আতর বিক্রির কাজ শুরু করি। কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারছিলাম না। সংসার চালানোই কষ্টকর ছিল। তখনই ডেকে নেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সব শুনে তিনি আমার হাতে একটি ভ্যানগাড়ি ও নগদ ১৬ হাজার টাকা তুলে দেন। সেই ১৬ হাজার টাকায় পুরাতন একটি ফ্লোর ক্লিনিং মেশিন কিনে অনেক চেষ্টায় গুলশানে মাত্র ছয়শ টাকায় টয়লেট ক্লিনিংয়ের কাজ পাই। এরপর গুলশান-বনানী এলাকায় ভ্যান চালিয়ে দ্বারে দ্বারে অনুরোধ করে কার্পেট, সোফা, ফ্লোর, টয়লেট, গ্লাস, কিচেন ক্লিনিং ও পেস্ট কন্ট্রোলের কাজ করেছি। 

মোস্তফা বলেন, হাতিরঝিলে এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ৩২ তলা ভবনের আউট সাইড গ্লাস ক্লিনিংয়ের কাজ পাই। তার ধারণা ছিল আমি হয়তো পারব না। আমাকে যে পারতেই হবে। চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সেই কাজটি সম্পন্ন করি। পারিশ্রমিক হিসেবে পাই দশ লাখ টাকা। এরপর বনানীতে একটি ২০ তলা ভবনের কাজ করে ১৬ লাখ টাকা পাই। 

আমি পাওয়ার প্রোপার্টি কেয়ার সার্ভিস লিমিটেড খুলি। সেটি যেখানে এখন কাজ করছে চারশ যুবক। প্রায় ৫০টি কোম্পানির সঙ্গে আমি এখন বাৎসরিক চুক্তিতে কাজ করছি। এক আকিজ গ্রুপের ৩৫টি কোম্পানিতে ক্লিনিংয়ের জন্য স্থায়ীভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। 

মোস্তফা বলেন, ক্লিনিংয়ে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমার ‘পাওয়ার প্রোপার্টি কেয়ার সার্ভিস লিমিটেড’ এর একটা বিশেষত্ব আছে। সেটা হলো এখানে যারা স্টাফ তাদের একটা বড় অংশ ছিলেন মাদকাসক্ত। মগবাজার এলাকার মাদকাসক্তদের খুঁজে খুঁজে বের করে নিজের ক্লিনিং কোম্পানিতে নিয়োগ দিয়েছি। এখানে চাকরি পেয়ে তারা সবাই স্বাবলম্বী। যারা সবাই এখন কাজে মনোযোগী। আমার ইচ্ছে কেউ যেন পরিবারের বোঝা না হয়। নিজের যোগ্যতায় সবাই নিজের পায়েই দাঁড়াক। এক সময়ের মাদকাসক্ত যুবক এখন আমার কোম্পানিতে বেতন পাচ্ছে ১২ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

জেইউ/কেএ