রাজধানীর বনশ্রীর ডি ব্লকে দীর্ঘদিন ধরে পরিবারসহ ভাড়া বাসায় থাকেন শারমিন আক্তার। ব্যাংকার স্বামীর এ গৃহিনীকে একাই সামাল দিতে হয় সংসার। কিন্তু পরিবারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রান্নার কাজটি তাকে করতে হয় প্রতিদিনের স্বাভাবিক রুটিনের বাইরে গিয়ে। তার কারণ গ্যাস সংকট। গ্যাসের সমস্যার কারণে প্রতিদিন রাত ১০টার পর তাকে রান্না করতে হয়। কখনো কখনো গ্যাসের পুরো চাপ পেতে মাঝ রাত হয়ে যায়। আর রাত জেগে তাকে যে খাবার রান্না করতে হয় তা খাবারের তালিকায় থাকে পরের দিনের জন্য।

শারমিন আক্তার জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমরাসহ আশপাশের এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস চলে যায়, সারাদিন গ্যাস থাকে না, যে কারণে কোনো রান্নাও হয় না। রাত ১০টার পর গ্যাস আসে, প্রথমে হালকা পরে মধ্য রাতের দিকে গ্যাসের পুরো চাপ পাওয়া যায়। তাই আমাকে পরের দিনের জন্য রান্না আগের রাতেই করে রাখতে হয়।

আরও পড়ুন >> মজুত গ্যাস দিয়ে ১১ বছরের চাহিদা মেটানো যাবে : প্রতিমন্ত্রী

শুধু বনশ্রী এলাকা নয়, দিনভর এমন গ্যাস সংকটের সমস্যায় ভুগছেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাসাবো, খিলগাঁও, মানিকনগর, মান্ডা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, জুরাইন, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, মুগদা, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের সংকট চলছে বেশ কয়েকদিন ধরেই। এছাড়া যেসব এলাকার বাসিন্দারা গ্যাস পাচ্ছেন সেখানেও স্বল্প চাপ বিরাজ করছে। অথচ কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে মাসিক বিল পুরোটাই নিচ্ছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

প্রতিদিন দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে প্রতিদিন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এক হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের। 

গ্যাংস সংকটের অভিযোগ জানিয়ে রাজধানীর পুরান ঢাকার বাসিন্দা আজাহার মোল্লা বলেন, গ্যাস না থাকার কারণে প্রায় দিনই দিনে কোনো রান্না করা যায় না। ফলে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে আনতে হয়, যে কারণে সংসার খরচ বাড়ছে প্রতি মাসেই। গ্যাস বিল পরিশোধ করেও সিলিন্ডার, কেরোসিনের স্টোভ কিনে রান্নার কাজ করছেন অনেকে। এগুলো কিনে রান্নার খরচ বাড়ানোর পরও মাসে ১০৮০ টাকা করে তিতাস গ্যাসকে বিল দিয়ে যাচ্ছি মাসের পর মাস। বারবার অভিযোগ জানালেও তারা বলে গ্যাস সংকট, কিছু করার নেই।

রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় একটি বাসায় মেস করে থাকেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র। তাদের একজন মকসুদুল হাসান আবির বলেন, আগে আমাদের মেসে সকালের দিকে বুয়া এসে দুপুরের জন্য রান্না করতো, সন্ধ্যার পর এসে রাতের জন্য রান্না করতো। কিন্তু কয়েক মাস ধরে দিনে গ্যাস না থাকায় সকালে বুয়া আর আসে না, দুপুরের রান্নাও হয় না। আমরা সবাই এখন দুপুরের খাবার বাইরের হোটেলে করি। আর রাতে বুয়া এসে রান্না করে শুধু একবেলার জন্য। গ্যাস সংকটের কারণে দুপুরে রান্না না হওয়ায় বাইরে খাবার খেয়ে আর্থিকভাবেও সংকটে পড়ছি প্রতি মাসে।

জানা গেছে, প্রতিদিন দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে প্রতিদিন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এক হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের। 

এদিকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে তিতাস গ্যাসের আবাসিক সংযোগ সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ ৫৮ হাজার। এছাড়া বাণিজ্যিক সংযোগ প্রায় ১২ হাজারের মতো। যার মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ১৫০০ মিলিয়ন। ফলে ৩০০ করে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। যে কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন গ্যাস সংকট দেখা যাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিতাস গ্যাসের এক কর্মকর্তা বলেন, পাইপ লাইনে গ্যাস সংকট থাকার কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। গ্রাহকদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযোগ জানানো হলেও আমরা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না। গ্যাস সরবরাহ পেলে আমরা গ্রাহকদেরও দিতে পারবো। এটা শুধুমাত্র আমাদের একক সমস্যা নয়, বৈশ্বিক সমস্যা। এছাড়া শীতের সময় তাপমাত্রা কমে গেলে অতিরিক্ত গ্যাস প্রয়োজন হয়। যে কারণে এসময় এসে গ্যাসের সংকট বেশি দেখা দিয়েছে। বর্তমানে গ্যাস সংকটের পাশাপাশি শীতের কারণে এই সমস্যা তীব্র হয়েছে।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন) সেলিম মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ কম থাকার কারণে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। মূলত ঘাটতি থাকার কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। গ্যাস সংকট এখন জাতীয় সমস্যা। আমরা যে পরিমাণ গ্যাস পাচ্ছি সেটাই গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করছি। কবে নাগাদ এই সংকটের সমাধান হবে তাৎক্ষণিকভাবে বলা যাচ্ছে না। গ্যাস সরবরাহ ঠিকমত আমরা পেলে গ্রাহকদেরও দিতে পারবো।

এএসএস/জেডএস