চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সামনে ডায়ালাইসিস ফি কমানোর আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তার মো. মোস্তাকিমকে থানা হেফাজতে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ উঠেছে। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেছে। গ্রেপ্তারের দিন রাতে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু ওই রাতে কোনো ওষুধ সেবন করতে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী মোস্তাকিম।

সোমবার (১৬ জানুয়ারি) রাতে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) দুপুরে গ্রেপ্তারের পর আমাকে প্রথমে থানা হাজতে নেওয়া হয়। আধ ঘণ্টা পর আমাকে ওসির পাশের একটি কক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে আমাকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর করে এক পুলিশ সদস্য। তিনি পুলিশের পোশাক পরে থাকলেও সেখানে কোনো নেমপ্লেট ছিল না। তাই উনার নাম আমি জানি না। মারধরের সময় আমাকে বারবার বলেছেন আমি নাকি দেখতে জামায়াত-শিবিরের মতো। আমি দাঁড়ি রাখছি কেন? কিছুক্ষণ মারধরের পর আমাকে আবারও থানার হাজতে নেওয়া হয়। তখন আমি ভালোভাবে হাঁটতে পারছিলাম না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওই দিন রাতে আমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর ডাক্তার দেখিয়ে আমার জন্য কিছু ওষুধ কেনা হয়। তবে রাতে আমাকে খাবার দিলেও ওই ওষুধ পুলিশ খেতে দেয়নি। পরদিন আমাকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। কিছুক্ষণ আগেও আমি ডাক্তার দেখিয়ে আসছি।’

মোস্তাকিমের মা নাসরিন আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এখনো চমেক হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে আসছি। আমার ছেলেকে ঘটনার দিন রাতে যখন থানা থেকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল তখন আমি সেখানে ছিলাম। পুলিশ আমাকে বলেছে আমার ছেলেকে একটু হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। জামিনের পর দেখছি মারধরের কারণে আমার ছেলে ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারছে না।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার একটি মাত্র ছেলে। আমার এ দুনিয়াতে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। মাদরাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি সে টিউশনি করে আমার চিকিৎসা করে। আমার ছেলেকে যারা এভাবে মেরেছে আমি তাদের বিচার চাই।

তবে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এরকম কোনো ঘটনা থানায় ঘটেনি। তিনি আদালতে কিছু বলেননি। জামিন পেয়ে অনুশোচনা থেকে মাকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। আমি তার মাকে সামান্য সহযোগিতা করেছি, যেহেতু তিনি ডায়ালাইসিস রোগী। তখনো তারা কিছু বলেননি। এখন কেন এসব অভিযোগ করছে বুঝতে পারছি না।

ওসি নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি

এদিকে চমেকে সংঘর্ষের ঘটনায় ওসি দায়ী কি না তা জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। গত ১৪ জানুয়ারি তিন সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠন করেন সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় সোমবার। তদন্ত কমিটিতে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারকে (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) প্রধান করা হয়েছে। এছাড়া সদস্য করা হয়েছে গোয়েন্দা উত্তর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) এবং নগর বিশেষ শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনারকে (এডিসি)।

তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (এডিসি) স্পিনা রানী প্রামাণিক। তিনি বলেন, গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওসির ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে যিনি দায়ী হবেন তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা গেছে, ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে ২০২৩ সালের শুরুতে চমেক হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনরা আন্দোলনে নামেন। কয়েকদিন ধরে চলা এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) বিক্ষোভকারীরা চমেকের প্রধান ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। এ দিন পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আন্দোলনকারীদের সড়ক ছেড়ে দিতে অনুরোধ করে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সড়ক না ছাড়ার ঘোষণা দেন। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি নিজের মুঠোফোন বের করে বিক্ষোভকারীদের ভিডিও ধারণ করেন এবং তাদের পরে দেখে নেবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন। এরপর একযোগে সবাই ওসির বিরুদ্ধে হইচই শুরু করেন এবং ভিডিও ডিলিট করার দাবি জানান।

গ্রেপ্তার মোস্তাকিমও ওসির সেই মোবাইল সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে হাতাহাতিতে ওসির মোবাইল মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। এরপর ওসি মোস্তাকিমকে পেটাতে পেটাতে চমেকের প্রধান ফটকের বিপরীতে এপিক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেও তাকে আরেক দফা মারধর করা হয়। কিছুক্ষণ পর এপিকের সামনে থেকে আরও একজনকে ওসি ধরে ভেতরে নিয়ে যান। পাশাপাশি অন্য পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোকারীদের ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে দেন।

একপর্যায়ে একজনকে ছেড়ে দিলেও মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। তবে মোস্তাকিম আন্দোলনে থাকলেও তার মা তখন চমেক হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাচ্ছিলেন। হাসপাতালে থাকতে তিনি শোনেন তার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কান্না করতে করতে তিনি হাসপাতাল থেকে সরাসরি পাঁচলাইশ থানায় চলে যান। সেখানে গিয়েও তিনি পুলিশ কর্মকর্তার মন গলাতে পারেননি।

এরপর ওই দিন রাতে সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় মোস্তাকিমকে। এছাড়া মামলাটিতে অজ্ঞাতনামা ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। এতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা ও কর্তব্য কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।

/এসএসএইচ/