পুলিশ কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করলে তাকে নিকটতম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করতে হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তাকে সাজা দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানা পুলিশ এই চর্চা করছে নিয়মিত। তারা অপরাধীকে আটক করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দিচ্ছে। এতে একদিকে আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে, অন্যদিকে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

২০১৯ সালের ২০ আগস্ট চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমী জেলার সব থানার অফিসার ইনচার্জদের সতর্ক করে একটি আদেশ জারি করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন- ওসিরা আটককৃত আসামিদের নিয়মিত আদালতে সোপর্দ না করে সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ইউএনও বা এসিল্যান্ডের সামনে উপস্থাপন করছেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর বিধান লঙ্ঘন করে আসামিদের আইনবহির্ভূতভাবে সাজা প্রদান করছেন। যা দেশের সংবিধান ও প্রচলিত অন্যান্য আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের বনাঞ্চলে ইন্টারপোলের নজরদারি

ওই আদেশে আরও বলা হয়, এ বিষয়ে সতর্ক করা হচ্ছে যে, পুলিশ কর্তৃক আটককৃত আসামিদের ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের সিদ্ধান্ত মান্য না করে আইনবহির্ভূত মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় সহায়তা করার কোনো সংবাদ আদালতের গোচরীভূত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের কারণে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং বিষয়টি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টকে অবহিত করা হবে।

আদেশটির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি, চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার, জেলার সকল ওসিকে নির্দেশনা দেন কামরুন্নাহার রুমীর ওই আদালত।

কিন্তু বিভিন্ন সময় আদালতের এই নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে চট্টগ্রামের অনেক থানা-পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোবাইল কোর্ট বসিয়ে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে থানার ওসিদের ভিন্ন একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। তারা পুরস্কারের আশায় এমনটি করেন বলে পুলিশেরই বেশ কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

যেমন, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার ওসি আতিকুর রহমান এমন বেশ কয়েকটি বেআইনি মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তিনি বন্যপ্রাণী উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করলে তাদের আদালতে না পাঠিয়ে প্রশাসনের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে কারাদণ্ড ও জরিমানার ব্যবস্থা করেন।

আরও পড়ুন : বাবুল-ইলিয়াসের বিরুদ্ধে মামলা : যেভাবে এগোচ্ছে তদন্ত

আইনজীবীরা বলছেন, জুডিশিয়াল আদালতে আসামির সাজা নিশ্চিত করতে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয়। অভিযোগ গঠন ও সাক্ষ্যগ্রহণে অনেক সময় লেগে যায়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ক্ষেত্রে এসবের দরকার হয় না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অপরাধ সংঘটিত হলে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষ স্বীকার করলে উপস্থিত সাজা দেওয়া যায়। তবে অপরাধ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই ঘটতে হয়।

জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) লোহাগাড়ার বার আউলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অভিযান পরিচালনা করে দুটি লজ্জাবতী বানর ও একটি প্যাঁচা উদ্ধার করে পুলিশ। একই সঙ্গে বন্যপ্রাণী পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে আটক করা হয়। এরপর ইউএনওর মাধ্যমে এসিল্যান্ডকে ডেকে চারজনকে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে সাজা দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেককে ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো লোহাগাড়া থানার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

এর আগে গত বছরের ৮ অক্টোবর লোহাগাড়ার চুনতি অভয়ারণ্যের ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে যাত্রীবাহী বাস থেকে একটি উল্লুক উদ্ধার করা হয়। সেদিনও উল্লুক পাচারের অভিযোগে আটক করা দুজনকে উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক বছর কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এভাবে বন্যপ্রাণী উদ্ধারের পর ভ্রাম্যমাণ আদালত ডেকে সাজা নিশ্চিত করার বিষয়টি আইনসিদ্ধ হচ্ছে কি না তা জানতে চট্টগ্রামের একাধিক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যপ্রাণী উদ্ধারের এসব অভিযান ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়। অভিযানে অংশ নেওয়া সফল পুলিশ কর্মকর্তাকে পুরস্কৃত করা হয়। একই সঙ্গে নির্দেশনা থাকে যে, সফল অভিযানের পাশাপাশি আসামিদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট পরিমাণ সাজা নিশ্চিত করতে হবে। এই পুরস্কার নিশ্চিত করতেই লোহাগাড়া থানার ওসি সহজ পথ বেছে নেন। আসামিদের আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সহযোগিতা নেন তিনি। ওসির আবদার রক্ষা করতে গিয়ে ইউএনও-এসিল্যান্ডরাও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন।

২০১৯ সালের ২০ আগস্ট চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমীর আদালতের এক নির্দেশনায় বলা হয়, ওসিরা আটককৃত আসামিদের নিয়মিত আদালতে সোপর্দ না করে সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ইউএনও বা এসিল্যান্ডের সামনে উপস্থাপন করছেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর বিধান লঙ্ঘন করে আসামিদের আইনবহির্ভূতভাবে সাজা প্রদান করছেন। যা দেশের সংবিধান ও প্রচলিত অন্যান্য আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ আটককৃত কোনো ব্যক্তিকে এসিল্যান্ড, ইউএনও বা কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তুলে দিয়ে সাজার ব্যবস্থা করতে পারে না। অপরাধীকে আটক করে তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম বিচারিক আদালতে সোপর্দ করতে হবে। বিলম্ব হলে তার কারণ উল্লেখ করতে হবে। পুলিশের হাতে আটক আসামিকে/অপরাধীকে তাৎক্ষণিক মোবাইল কোর্ট বসিয়ে সাজা দেওয়ার কোনো বিধান আইনে নেই। এটা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অজ্ঞতা বা ক্ষমতার অপব্যবহার। এ ধরনের মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী অনেক কর্মকর্তার ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা উচ্চ আদালত কেড়ে নিয়েছেন।

 এ বিষয়ে লোহাগাড়া থানার ওসি আতিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখানে আইন অনুযায়ীই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। আমরা পুলিশ এবং এসিল্যান্ড মহোদয় একসঙ্গেই অভিযান পরিচালনা করেছি। আমাদের কাছে ছবি আছে। অভিযানের পর অপরাধীদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে কোর্ট বসানো হয়েছে ।’

তবে, গতকাল শুক্রবার ওসি আতিকুর রহমান এ ঘটনায় যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন তাতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, অভিযান পরিচালনা করে অপরাধীদের আটকের পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ডেকে আনা হয়েছিল।

থানার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- ‘লজ্জাবতী বানর ও প্যাঁচা উদ্ধারের বিষয়টি আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ উল্লাহকে অবহিত করি। তিনি এসিল্যান্ড (সহকারী কমিশনার ,ভূমি) মো. শাহাজাহানকে অভিযান পরিচালনাকারী দলের কাছে পাঠান। এরপর এসিল্যান্ড অবৈধভাবে পাচারের উদ্দেশ্যে বন্যপ্রাণীগুলো শিকার ও হেফাজতে রাখার অপরাধের বিষয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে চারজনের প্রত্যেককে ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে এসিল্যান্ড ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহজাহানকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে তাকে মুঠোফোনে এসএমএস দেওয়া হয়। জবাবে তিনি লেখেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতে অপরাধ উদঘাটিত হলে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ বিষয়ে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর ধারা ৬ (১) এ নির্দেশনা রয়েছে।’

তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘নির্দেশনাটি হলো, অপরাধটি ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ঘটলে প্রযোজ্য হবে। লোহাগাড়ার ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় কেউ আটক হননি। আটকের পর মোবাইল কোর্ট বসানো হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। এক্ষেত্রে পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উভয়েই আইন ভঙ্গ করেছে।’

এমআর/এসকেডি/জেএস