চারটি কোম্পানির মধ্যে এয়ার ইজিপ্ট ছাড়া বাকি তিনটি কোম্পানির বিশ্বের মধ্যে উন্নতমানের উড়োজাহাজ সরবরাহকারী কোম্পানি হিসেবে সুনাম রয়েছে। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে এয়ার ইজিপ্ট প্রথম ছিল। কিন্তু তাদের এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিনগুলো প্রায় ১২-১৫ বছরের পুরোনো এবং দুর্বল। যেগুলোর স্পেয়ার পার্টস পাওয়া খুব কঠিন। ফলে পাঁচ বছরের চুক্তিতে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের দুটি উড়োজাহাজ লিজ নিলেও প্রথম বছর শেষেই একটি এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। আর দ্বিতীয়টির ইঞ্জিনও দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হয়। তাতে পাঁচ বছরে সরকারের এক হাজার ১৬১ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে সরকারের।

যে কারণে দীর্ঘ অনুসন্ধানে সরকারের ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা ক্ষতি ও আত্মসাতের অভিযোগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের ২৩ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

আরো পড়ুন >> বিমানের ২৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন

সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ কমিশনের উপপরিচালক জেসমিন আক্তার বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

যাদেরকে আসামি করা হয়েছে- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন্স ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদ, সাবেক ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. শফিকুল আলম সিদ্দিক, মহা-ব্যবস্থাপক মো. আবদুর রহমান ফারুকী, সাবেক মুখ্য প্রকৌশলী শহীদ উদ্দিন মোহাম্মদ হানিফ, সাবেক মুখ্য প্রকৌশলী দেবেশ চৌধুরী, এয়ারওয়ার্থিনেস কনসালট্যান্ট গোলাম সারওয়ার, প্রকৌশলী মো. সাদেকুল ইসলাম ভূঞা, ডিজিএম কামাল উদ্দিন আহমেদ। 

এছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রধান প্রকৌশলী এ আর এম কায়সার জামান, প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার (কাস্টমার সার্ভিস) শরীফ রুহুল কুদ্দুস, সাবেক ক্যাপ্টেন মো. নজরুল ইসলাম শামিম, উপমহাব্যবস্থাপক (এওসি, এসিপি) জিয়া আহমেদ, সাবেক চিফ পার্সার কাজী মোসাদ্দেক আলী, ফ্লাইট পার্সার মো. শহিদুল্লাহ কায়সার ডিউক, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. আজাদ রহমান, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল কাদির, সাবেক উপপ্রধান প্রকৌশলী মো. শাহজাহান, সাবেক ইঞ্জিনিয়ার অফিসার মো. জাহিদ হোসেন, সহকারী ব্যবস্থাপক মো. ফজলুল হক বসুনিয়া, ব্যবস্থাপক মো. আতাউর রহমান, চিফ পার্সার মোহাম্মদ সাজ্জাদ উল হক (শাহিন), ফ্লাইট পার্সার শাহনাজ বেগম ঝর্ণা ও সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার গাজী মাহমুদ ইকবালকে আসামি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন জানান, ২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে মিশরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। প্রথম বছর শেষে দুটি এয়ারক্রাফটেরই ইঞ্জিন বিকল হয়। ইঞ্জিনগুলো প্রায় ১২-১৫ বছরের পুরোনো এবং উড্ডয়ন যোগ্যতার মেয়াদকাল কম থাকায় ইঞ্জিনগুলো পুরোপুরি বিকল হয়ে যায়। পরে উড়োজাহাজ সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকেই ভাড়ায় আনা হয় আরও একটি ইঞ্জিন। দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হয় সেই ইঞ্জিনটিও। এতে পাঁচ বছরে দেশের এক হাজার ১৬১ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির তদন্তে উঠে এসেছে। এরপর স্থায়ী কমিটির পাঠানো ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নামে দুদক। দীর্ঘদিন অনুসন্ধানে শেষে এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়ায় ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। 

মামলার এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটি উড়োজাহাজ লিজ নিয়ে রি-ডেলিভারি পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মোট ১ হাজার ১৬১ টাকা ক্ষতি  এবং আত্মসাৎ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার এজাহার ও অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে বিমানের বোর্ড অব ডিরেক্টর এবং এমডির সমন্বয়ে বিমানের ১১৬তম সভায় বি-৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিমান লিজ গ্রহণের জন্য পরের বছর দরপত্র আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে, পর্তুগাল ও মিশনের চারটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) এম এম আসাদুজ্জামানের সভাপতিত্বে ১৪ সদস্য সমন্বয়ে ফিন্যান্সিয়াল সাব-কমিটি মিশনের ইজিপ্ট এয়ার হোল্ডিং কোম্পানিকে একই বছরের ২৩ অক্টোবর প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী চারটি কোম্পানির মধ্যে এয়ার ইজিপ্ট ছাড়া বাকি তিনটি কোম্পানিই বিশ্বের মধ্যে উন্নতমানের উড়োজাহাজ সরবরাহকারী কোম্পানি বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে এয়ার ইজিপ্ট প্রথম সর্বনিম্ন এবং লন্ডনের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হয়। এই দুটির মধ্যে এয়ার ইজিপ্টের ইঞ্জিন ছিল অনেক পুরোনো এবং দুর্বল। যার স্পেয়ার পার্টস পাওয়া খুব কঠিন এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ইঞ্জিন ছিল অনেক ভালো। এটি বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান এবং দ্বিতীয় সর্বনিম্ন কোম্পানি সেখানে দর-দামের সুযোগ ছিল।

বাংলাদেশ বিমান চুক্তি করার আগে উড়োজাহাজ দুটির ফিজিক্যাল ইন্সপেকশনের জন্য ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদের নেতৃত্বে আট সদস্য একটি দল মিশরে পরিদর্শনে যান। পরির্দশন দলের সিদ্ধান্তে উড়োজাহাজ দুটি লিজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও এয়ারক্রাফট দুটির বেশকিছু রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ছিল। নিয়ম অনুযায়ী অসম্পূর্ণ থাকলে এয়ারক্রাফট তার উড্ডয়ন যোগ্যতা হারায় মর্মে প্রতীয়মান হয়। পরিদর্শন টিম অসৎ উদ্দেশ্যে অসম্পূর্ণতার বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনি।

দরপত্র অনুযায়ী উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের কমপক্ষে ৪০০০টি সাইকেল অবশিষ্ট থাকতে হবে। কিন্তু লিজ নেওয়া উড়োজাহাজ দুটির মধ্যে একটি এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন ৩৬১৫টি সাইকেল এবং অপরটির ইঞ্জিন ২১০০টি সাইকেল অবশিষ্ট ছিলো, যা সম্পূর্ণভাবে দরপত্রের উল্লেখিত শর্তবিরোধী। উড়োজাহাজ দুটি ৫ বছরের জন্য লিজ নেওয়া হলেও মাত্র ১১ মাস পর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত উড়োজাহাজ দুটির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। এরপর ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে নিয়ে মেরামত করতে না পারায় একটি উড়োজাহাজটি গ্রাউন্ডেড হয়। উড়োজাহাজগুলো সচল রাখার জন্য ইজিপ্ট এয়ার থেকে পুনরায় আরও চারটি ইঞ্জিন লিজ নেওয়া হয় এবং সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায়।

বাংলাদেশ বিমান নিয়মিত ফ্লাইট চালুর স্বার্থে ও ব্যবসায়িক উদ্দেশে ইজিপ্ট এয়ার থেকে উড়োজাহাজ বা এয়ারক্রাফট লিজ গ্রহণ করে। কিন্তু এ লিজের মাধ্যমে বিমান বাংলাদেশ ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার পরিবর্তে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা ক্ষতি সাধনসহ আত্মসাত করা হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ঘটনা ঘটে।

আরএম/জেডএস