বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মো. হাসান ছালামকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৩ এর একটি দল। হাসান ছালাম কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের পাড়াগ্রামের আব্দুস ছালামের ছেলে।

র‌্যাব-৩ জানিয়েছে, যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন হাসান ছালাম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—জেমস সুপার শপ লিমিটেড, জেমস অ্যান্ড জুয়েলার্স, মতিঝিলে মা টেলিকম, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে উজির আলী ট্রাভেলস, কুমিল্লা কান্দিরপাড়ে ডায়মন্ড গ্যালারি লিমিটেড, গুলিস্তানে জামিল কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, মালিবাগ টুইন টাওয়ারে এশিয়ান স্কাই শপ, বারিধারায় জেমস গ্রুপ, জেমস এ্যাগ্রো ফুড লিমিটেড, জেমস গ্যালারি লিমিটেড ও জেমস রিয়েল অ্যাস্টেট লিমিটেড।

দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিক মুনাফা লাভের আশায় একাধিক প্রতিষ্ঠানে যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করেন তিনি। তিনি ব্যবসায়িক অংশীদারসহ আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত লোকজনের কাছ থেকে উচ্চ হারে মাসিক লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে কোটির টাকার বেশি হাতিয়ে নেন। 

এছাড়া কিছুদিন লভ্যাংশ দিলেও পরবর্তীতে লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করে দিতেন। পাওনাদাররা টাকার জন্য নিয়মিত তাগিদ দিতে থাকলে তিনি টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিতেন। পাশাপাশি চেক দিলেও নির্ধারিত তারিখে তার অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা পাওয়া যেত না ও ব্যাংক কর্তৃক চেক ডিজঅনার করা হতো। এভাবে তিনি প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেন। পরে টাকা ফেরত চাইলে পাওনাদারদের বিভিন্ন ধরনের হুমকি ও প্রাণনাশের ভয়ভীতি দেখান। এক পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে চেক জালিয়াতির মামলা দায়ের করেন পাওনাদাররা।

মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, হাসান ছালাম বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ফাইন্যান্স, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইউসিবি ব্যাংক, ইবিএল, প্রাইম ব্যাংক এবং প্রিমিয়াম ব্যাংকসহ আরও বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ঋণ নেন। 

প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটি মাসিক কিস্তি পরিশোধ করে পরবর্তীতে তা বন্ধ করে দেন। নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও সেগুলো পরিশোধ না করায় এসকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তাকে বারবার চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়। এতেও কাজ না হলে তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে আর্থিক ঋণ খেলাপের দায়ে মামলা দায়ের করা হয়। 

বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক তাকে বারবার টাকার বিষয়ে মীমাংসা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবুও তিনি কখনই বিজ্ঞ আদালতে হাজির হননি। এছাড়া বিজ্ঞ আদালতে চলমান মামলাগুলোর শুনানিতেও হাজিরা দেননি। কৌশলে এসব ঋণের দায় এড়ানোর জন্য তিনি তার বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং দোকান বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কুমিল্লা ও ময়মনসিংহে জমি কেনেন। 

তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি রাজধানীর পান্থপথের আলিশান ফ্ল্যাট বিক্রি করে ডেমরা এলাকায় বন্ধুর বাসায় আত্মগোপন করেন। পলাতক থাকা অবস্থায় মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশ ছেড়ে ইউরোপে পালিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

হাসান ছালাম জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ২০০৮ সালে কুমিল্লায় মাসিক হারে লভ্যাংশ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কতিপয় লোকজনের কাছ থেকে অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় তিনি বসুন্ধরা সিটিতে প্রথমে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে জেমস সুপার শপ নামে পাথরের ব্যবসা শুরু করেন।

পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যক্তিসহ বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে বসুন্ধরা সিটিতে আরও চারটি দোকান ভাড়া করে বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করেন। বিভিন্ন জায়গায় ফ্ল্যাটের ব্যবসায় এসব অর্থ বিনিয়োগ করেন। এছাড়া তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পুঁজি করে ও জমি মরগেজ দিয়ে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতেন। পরে প্রথম কয়েকটি মাসিক কিস্তি পরিশোধ করে পরবর্তীতে তা বন্ধ করে দিতেন। এছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছ থেকে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিতে তা পরিশোধে অস্বীকৃতি জানান।

২০১৮ সাল থেকে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা হয়। এরপর মামলা চলতে থাকে ও ২০২০ সালে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তখন থেকে তিনি রাজধানীর ডেমরা, উত্তরা, কেরানীগঞ্জ ও মতিঝিল এলাকায় আত্মগোপন করেন। তার বিরুদ্ধে অর্থ ঋণ জালিয়াতি, চেক জালিয়াতি ও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ বলেন, তিনি জেমস সুপার শপে (বসুন্ধরা সিটি) অংশীদারিত্বে মাসিক ৫০ হাজার টাকা করে লভ্যাংশ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গিয়াস উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেন। পরবর্তীতে গিয়াস উদ্দিন প্রতি মাসের লাভের টাকা চাইলে তিনি বিভিন্নভাবে টালবাহানা করতে থাকেন। গিয়াস উদ্দিন লাভের টাকা না পাওয়ায় নিরুপায় হয়ে তার মূলধন ফেরত চান। তখন হাসান ছালাম পাওনাদার গিয়াস উদ্দিনকে তার মূলধন ফেরত না দিয়ে উল্টো হুমকি দেন ও যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। 

পরবর্তীতে গিয়াস উদ্দিন বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ২০২২ সালে বিজ্ঞ আদালত যাবজ্জীবন হাসান ছালামকে কারাদণ্ড দেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ তাকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

জেইউ/কেএ