দুবাইয়ের প্রধান আকর্ষণ আকাশচুম্বী অট্টালিকা বুর্জ খলিফা

করোনাকালে দীর্ঘ লকডাউনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে বিশ্ববাসী। দিনের পর দিন ঘরে থাকতে ভালো লাগে কার? ভ্রমণপিপাসুদের কাছে নিজের ঘরই যেন হয়ে ওঠে জেলখানা। এমন পরিস্থিতিতে লকডাউন কিছুটা শিথিল হলেই বিশ্ববাসীর জন্য খুলে দেওয়া হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে জনবহুল শহর দুবাই।

২০২০ সালের ৭ জুলাই বিদেশি পর্যটকদের জন্য দুবাইয়ের দুয়ার খোলার পর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন ভ্রমণপিপাসুরা। চরম শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার আর জরিমানার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি বর্তমানে পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ। একজন পর্যটক বিমানবন্দরে নামার পর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মানা হয় স্বাস্থ্যবিধি। এমনকি আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, নাইট ক্লাব, মসজিদ ও টুরিস্ট স্পটগুলোতেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে দৃঢ়ভাবে। ফলে করোনা নিয়ে ভয় ও দুশ্চিন্তা ঝেড়ে দুবাইয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারছেন পর্যটকরা।

নিরাপদ হোটেল

সরেজমিনে দুবাইয়ের অত্যাধুনিক এলাকা ডাউনটাউন ও ডেরার কয়েকটি আবাসিক হোটেলে গিয়ে দেখা গেছে, মাস্ক ছাড়া এগুলোর কোনোটিতেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। শুধু মুখে মাস্ক লাগালেই হবে না, সেটি দিয়ে নাক ও মুখের নিচ পর্যন্ত ঢাকা থাকতে হবে।

কেউ যদি মাস্ক না পরেন তাহলে হোটেলের গেট থেকে তাকে মাস্ক দেওয়া হচ্ছে। সেই মাস্ক পরার পর তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি হোটেলের লবিতে রয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। লবির সোফাগুলোতে রয়েছে সামাজিক দূরত্ব মেনে বসার নির্দেশনা। সেখানে দুজন যাতে পাশাপাশি বসতে না পারেন সেজন্য একটিতে লাল ফিতা দিয়ে চিহ্ন দেওয়া রয়েছে।

দুবাই শহরের ডেরা এলাকা, অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশির দেখা মেলে এখানে | ছবি- ঢাকা পোস্ট

এছাড়া হোটেলের লিফটে কে কোথায় দাঁড়াবেন সেই নির্দেশনা দেওয়া আছে। প্রতিটি হোটেলের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট ও বারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। একজনের সঙ্গে অন্যজনের কমপক্ষে ২ মিটার সামাজিক দূরত্ব রেখে বসার নির্দেশনা দেওয়া আছে। পাশাপাশি নিয়মিত হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া আছে।

প্রতিটি রেস্টুরেন্টে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট বসে খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ৩০ মিনিট পর সবাইকে উঠে যাওয়ার অনুরোধ করছেন হোটেল কর্তৃপক্ষ।

নিরাপদ দুবাইয়ের সড়ক

দুবাইয়ের প্রতিটি সড়ক এবং সড়কের পাশের দোকানগুলোতে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে লেখা হয়েছে। সড়কের পাশের বেঞ্চগুলোতেও মাঝের সিট ফাঁকা রেখে দুই কোনায় দুজনকে বসার নির্দেশনা দেওয়া আছে। এছাড়া সড়কের প্রতিটি দোকানে মাস্ক ছাড়া প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার পোস্টার দেওয়া আছে। দোকানিরা কোনোভাবেই মাস্ক ছাড়া কাউকে দোকানে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না।

এছাড়া প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে বড় ব্যানার টাঙানো রয়েছে। এগুলোতে লেখা রয়েছে- মাস্ক পড়ুন, হাতে ডিস্পোজেবল গ্লাভস পড়ুন, হাঁটাচলার সময় দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন এবং ঘর থেকে বের হওয়া ও ঢোকার সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন।

বাসে দাঁড়ানো ও বসার নিয়ম

দুবাইয়ের প্রতিটি বাসে দাঁড়ানো এবং বসার পৃথক নিয়ম রাখা হয়েছে। নিয়ম না মানলে যাত্রীদের বাসভেদে ভিন্ন ভিন্ন অংকের জরিমানার বিধান রয়েছে। সরেজমিনে দুবাইয়ের একটি বাসের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, তিনজনের বসার সিটের মাঝেরটাতে লাল স্টিকার দিয়ে বসতে নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়া পাশাপাশি দুজনের সিটে বসতে পারবেন একজন। বাসে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের জন্যও একটি পোল তৈরি করা হয়েছে।

দুবাইয়ে বাসের মধ্যেও মানতে হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি

যাত্রীরা পোলের চারদিকে এক মিটার দূরত্বে দাঁড়াবে। যাত্রীদের দাঁড়ানোর জায়গায় স্টিকার দিয়ে চিহ্ন দেওয়া রয়েছে। স্টিকারের বাইরে দাঁড়ালেই দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।

নিরাপদ বিমানবন্দর

দুবাইয়ের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হচ্ছে। যেকোনো ফ্লাইট থেকে নামার পর যাত্রীদের জন্য বিমানবন্দরে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যাত্রীরা ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করবেন মাস্ক পরে। তবে ৫ থেকে ৭ সেকেন্ডের জন্য ইমিগ্রেশনে ছবি তুলতে মাস্ক একটু নিচে নামাতে হচ্ছে।

স্বপ্নের শহর দুবাই। পর্যটকদের জন্যও আকর্ষণীয় স্থান এটি | ছবি- ঢাকা পোস্ট 

ইমিগ্রেশন শেষে বাধ্যতামূলক করোনা টেস্টের জন্য যান যাত্রীরা। বিমানবন্দরে ৩০টির মতো করোনার নমুনা সংগ্রহের বুথ রয়েছে। যাত্রীরা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে নমুনা দেন। নমুনার ফলাফল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মোবাইলের এসএমএসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

শপিং মল

সরেজমিনে দুবাই মলে গিয়ে দেখা গেছে, আগত দর্শনার্থীদের মাস্ক পরাসহ একসঙ্গে দাঁড়াতে দিচ্ছেন না নিরাপত্তারক্ষীরা। দর্শনার্থীদের কেনাকাটা বা ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে ফাঁকা ফাঁকা হয়ে। এছাড়া মলের প্রতিটি শোরুম ও রেস্টুরেন্টে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রয়েছে। দেওয়া আছে ফাঁকা ফাঁকা করে বসার নির্দেশনাও। চার সিটের টেবিলে এক পরিবারের সর্বোচ্চ তিনজন করে বসতে পারবেন।

মাস্ক না পরে শপিং মলে প্রবেশ নিষেধ 

মাস্ক না পরলে জরিমানা ৭৫ হাজার

দুবাইয়ের জায়গায় জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি ও মাস্ক নিয়ে পোস্টার লাগানো রয়েছে। পোস্টারে লেখা রয়েছে- মাস্ক না পরলে ৩০০০ দিরহাম (প্রায় ৭৫ হাজার বাংলাদেশি টাকা) জরিমানা করা হবে।

দুবাইয়ের মসজিদ

দুবাইয়ে টুরিস্ট স্পটের পর সবচেয়ে বেশি সমাগম হয় মসজিদে। তাই মসজিদে অত্যন্ত কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। সরেজমিনে দুবাইয়ের ডেরা এলাকার নাসের আব্দুল্লা হোসেইন মসজিদ, মসজিদ ইমাম, মসজিদ বিলালে গিয়ে দেখা যায়, মুসল্লিরা পরস্পরের মধ্যে এক মিটার জায়গা ফাঁকা রেখে নামাজ পড়ছেন। সবাইকে জায়নামাজ নিয়ে মসজিদে যেতে বলা হচ্ছে। তবে কেউ যদি জায়নামাজ নিয়ে যেতে না পারেন তার জন্য একটি পলিথিনের টুকরা দেওয়া হচ্ছে। সেই পলিথিনে সিজদাহ এবং নামাজ পড়ে নির্দিষ্ট বাস্কেটে সেটি ফেলে দিতে হচ্ছে।

মসজিদের মধ্যেও মেনে চলতে হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি

দুবাই সরকারের পক্ষ থেকে মসজিদে হ্যান্ডশেক, খালি হাতে কোরআন শরীফ ধরা এবং বয়স্ক ও শিশুদের মসজিদে আসতে মানা করা হয়েছে। অজুখানায় ফাঁকা হয়ে দাঁড়াতে বলা হয়েছে এবং মূল জামাত শেষ হওয়ার পর পৃথক কোনো জামাত না করতে বলা হয়েছে। দুবাইয়ের মসজিদে একমাত্র অজুর সময় ছাড়া বাকি সময় মাস্ক পরে থাকতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বুর্জ খলিফায় ছবি তোলায় বিধিনিষেধ

দুবাইয়ের প্রধান আকর্ষণ আকাশচুম্বী অট্টালিকা বুর্জ খলিফা। প্রতিদিন হাজারও পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত থাকে এটি। বুর্জ খলিফার পাশেই দুবাই মলে এসে সবাই এটির সঙ্গে ছবি তুলতে চান। তবে পর্যটকদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তার জন্য এখানেও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে দুবাই কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বুর্জ খলিফার সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে দেওয়া হয় না। হাঁটার মধ্যেই তুলতে হয় ছবি। একটু দাঁড়ালেই পর্যটকদের সামনে যেতে বলা হয়। এছাড়া বুর্জ খলিফার সামনের লেকে প্রতি আধাঘণ্টা পরপর ফাউন্টেন শো অনুষ্ঠিত হয়। সেই শো দেখতে হলেও পর্যটকদের মাটিতে দাগ কাটা ঘরে ফাঁকা ফাঁকা হয়ে দাঁড়াতে হয়।

দুবাইয়ের কড়া স্বাস্থ্যবিধিতে বিরক্ত নন পর্যটকরা। তারা বলছেন, আমাদের সুস্থ রাখতেই দুবাইয়ের এত আয়োজন। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে বুর্জ খলিফায় আসা সর্দার আবু জাফর নামের এক পাকিস্তানি পর্যটক ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুবাইয়ে আসার পর থেকে হোটেল, মার্কেট ও পর্যটন স্পটগুলোতে অত্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এখানে ভ্রমণ উপভোগ করছেন সবাই। করোনার এমন সময়েও দেশটি সত্যিই খুব নিরাপদ মনে হয়েছে। 

এআর/এইচকে/এমএআর/