গোয়েন্দা পরিচয়ে অন্যের বাড়িতে লুটপাট করেন নাহিদ
সুনামগঞ্জ সদরের নারায়ণতলা গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা পরিচয়ে তল্লাশির নামে শ্লীলতাহানি ও লুটের ঘটনায় এক ব্যক্তিকে আটক করেছে র্যাব।
বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাকে আটক করে র্যাবের একটি দল। আটককৃত ব্যক্তির নাম আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গত ২৫ জানুয়ারি রাতে সুনামগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার নারায়ণতলা গ্রামে কিছু দুষ্কৃতকারী কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালায়। তারা নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দেয়।
বিজ্ঞাপন
অভিযানের নামে তারা বেশ কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট করে এবং তল্লাশির নামে এক গৃহবধূর শ্লীলতাহানি ঘটায়।
ওই ঘটনায় এক ভুক্তভোগী বাদী হয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। সংশ্লিষ্ট থানা থেকে আসামিদের আটকে র্যাবের সহায়তা চাইলে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি র্যাব-৪ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি বিজন রায়কে মিরপুর মডেল থান এলাকা থেকে আটক করে।
আটক হওয়া বিজনের মাধ্যমে র্যাব জানতে পারে সুনামগঞ্জে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে লুটপাট ও চাঁদাবাজির মূল পরিকল্পনাকারী আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ। ওই তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব ডলার নাহিদকে গত রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে আটক করে।
আব্দুল কুদ্দুস মিরপুর পল্লবীর আলী আজগরের ছেলে। তার কাছ থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া পরিচয়পত্র এবং প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরিহিত ছবি উদ্ধার করা হয়েছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আব্দুল কুদ্দুস ডলার ঘটনার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে।
কমান্ডার মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে আব্দুল কুদ্দুস বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে মানুষের কাছে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিতো।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, আব্দুল কুদ্দুস ২০০৯ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি নিজেকে ১৯৯৬ সালের এসএসসি ব্যাচ দাবি করেন। বিভিন্ন কৌশলে ওই ব্যাচের ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হয়ে নিজেকে গোয়েন্দা শাখা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। বিভিন্ন সময় অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির টাকা, জমি ও ফ্ল্যাট উদ্ধারের নামে প্রতারণা করেন।
তিনি নিজেকে গোয়েন্দা শাখা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন বাহিনী ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়ি থেকে তল্লাশির সময় নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি প্রতারণার মাধ্যমে কৌশলে প্রশাসনের সহায়তা নেন।
প্রতারণার কৌশল হিসেবে তিনি পরিচিতদের কাছ থেকে ভুক্তভোগী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আস্থা অর্জন করতেন।
আটক আব্দুল কুদ্দুস জানিয়েছেন, ৪/৫ মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি গ্রুপের মাধ্যমে তার বিজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে রাজধানীতে তিনি বিভিন্ন সময় পূর্বে গ্রেপ্তার বিজনের সঙ্গে ৭/৮ বার সাক্ষাৎ করেন এবং বিজনের বাড়ি সুনামগঞ্জে হওয়ায় তিনি বিজনের আমন্ত্রণে সুনামগঞ্জ যান।
বিজন সুনামগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার সু-সম্পর্ক ছিল। পরে বিজনের সঙ্গে আব্দুল কুদ্দুস সুনামগঞ্জে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে কৌশলে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান যে, এখানে সে মাদকের একটি চালানের বিরুদ্ধে অভিযান করতে এসেছেন এবং অভিযানের জন্য তাদের সহায়তা দরকার।
এসময় বিজন ও অন্যান্য সহযোগীদের সমন্বয়ে সুনামগঞ্জ জেলার সদর থানাধীন নারায়ণতলা এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে লুটের জন্য পরিকল্পনা করেন। তারা লুটের উদ্দেশে এলাকার বিত্তশালী কয়েকটি বাড়ি টার্গেট করে এবং ৩ দিন ধরে টার্গেট করা বাড়ি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ও বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করে।
পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক চেয়ারম্যান মোকসেদ আলী বাড়িসহ আশেপাশের বাড়িতে তল্লাশি করে এবং বাড়িতে থাকা লোকজনের শ্লীলতাহানি করে। এসময় তারা তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করে নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নেয়।
ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে তারা অভিযান শেষ করে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন তাদের আটক করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সংবাদ দেয়।
এসময় নিজেকে গোয়েন্দা শাখার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় আব্দুল কুদ্দুস।
গত ৫/৬ বছর ধরে ঢাকা ও পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গোয়েন্দা সংস্থার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়ি থেকে নগদ অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করেছে আব্দুল কুদ্দুস।
আটক আব্দুল কুদ্দুস ঢাকা জেলার একটি স্কুল থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। ২০১৬ সালে ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নেয়। সিকিউরিটি গার্ডে চাকরির সুবাদে তিনি বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারেন।
এসব কার্যক্রমকে রপ্ত করে গত ৫/৬ বছর ধরে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতারণা করে আসছিলেন। ইতোপূর্বে তিনি গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে হুমকি দেওয়ার সময় র্যাবের হাতে আটকের পর বেশকিছুদিন কারাভোগ করেছেন। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
জেইউ/এসএম