আদালতের আদেশ অমান্য করে খতিয়ান সৃজন করেন বাকলিয়া সার্কেলের এসিল্যান্ড (সহকারী কমিশনার-ভূমি) আতিকুর রহমান/ ঢাকা পোস্ট

বিচারিক আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে একটি জমির খতিয়ান সৃজনের (তৈরি) অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের বাকলিয়া সার্কেলের সাবেক এসিল্যান্ডের (সহকারী কমিশনার- ভূমি) বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ আগস্ট এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন এক ভুক্তভোগী।

গত বছরের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত একটি অভিযোগ দেন নগরীর বাসিন্দা আবদুল মোমেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, আইনি জটিলতা থাকা একটি সম্পত্তির খতিয়ান সৃজনের বিষয়ে তার আপত্তির প্রেক্ষিতে আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের আদেশ অমান্য করে খতিয়ান সৃজন করেন বাকলিয়া সার্কেলের এসিল্যান্ড (সহকারী কমিশনার-ভূমি) আতিকুর রহমান। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসিল্যান্ড এ কাজ করেছেন বলে দাবি তার। এই অনিয়মে জড়িত এসিল্যান্ডসহ ভূমি অফিসের অন্য কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি জানান আব্দুল মোমেন।

খতিয়ান সৃজনের বিষয়ে আপত্তির প্রেক্ষিতে আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন/ ঢাকা পোস্ট

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে থাকা (গোপনীয় শাখা) লিখিত ওই অভিযোগ থেকে জানা গেছে, গত বছরের ১৭ আগস্ট চট্টগ্রাম বাকলিয়া সার্কেল থেকে তিনটি খতিয়ান সৃজন (তৈরি) করা হয়। খতিয়ান তিনটি হলো- ২৩৫৬, ২৩৫৭ ও ২৩৫৮। এ তিনটি খতিয়ান সৃজনের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে এসিল্যান্ড বরাবর আগের মাসে (২৭ জুলাই) আবেদন করেছিলেন আব্দুল মোমেন। ওই আবেদনের সঙ্গে আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশও জমা দিয়েছিলেন তিনি। তারপরও তার আপত্তির বিষয়ে কোনো শুনানি করেননি এসিল্যান্ড। তিনি একতরফা খতিয়ান সৃজনের আদেশ দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে সম্পত্তির বিক্রি ও খতিয়ান সৃজন নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে সেটির অবস্থান চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায়। এখানকার জমির মূল্য অনেক বেশি। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা শপিং মল করার উপযোগী জায়গা এটি। সংশ্লিষ্ট জমির যেটুকু অংশ বিক্রি হয়েছে সেটি মোট তিনজনের কাছে বিক্রি করা হয়। প্রতিটি দলিলে মূল্য দেখানো হয়েছে ৫৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। তিনজনের কাছে মোট ১ কোটি ৬০ লাখ ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। যারা বিক্রির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন তারা ৫ শতাংশ ক্ষতিপূরণসহ সমপরিমাণ টাকা আদালতে জমা দিয়ে অগ্রক্রয় মামলা করেছেন।

এ ব্যাপারে তদন্ত করে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজার ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা লক্ষীন্দর দাশ ২০২২ সালের ৫ জুলাই মতামত দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, যেহেতু নামজারির বিষয়ে আপত্তি রয়েছে সেহেতু উভয় পক্ষের শুনানি সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু গত বছরের ১৭ আগস্ট এসিল্যান্ড আতিকুর খতিয়ান সৃজনের যে আদেশ দেন তাতে উল্লেখ রয়েছে ‘নামজারির ব্যাপারে আপত্তি পাওয়া যায়নি।’

জানা গেছে, রিয়াজউদ্দিন বাজারের বটতলী মৌজায় ১০ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন জাহান আরা বেগম নামে এক নারী। উত্তরাধিকার সূত্রে তার সম্পত্তির ১৬ আনার মধ্যে ২ আনার মালিক অভিযোগকারী আব্দুল মোমেনের পরিবার।

আব্দুল মোমেনের দাবি, ওই সম্পত্তির অন্য অংশীদাররা তাদের না জানিয়ে একটি অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন। যদিও আইনে আছে এ ধরনের জমি বিক্রি করতে হলে বাকি অংশীদারদের অবশ্যই জানাতে হবে এবং তারা কিনতে চাইলে তাদের কাছে বিক্রি করতে হবে। অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনের ২৩ ধারায় বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।

নোটিশ না দিয়ে জমি বিক্রি করায় ওই জমির খতিয়ান সৃজন না করতে আব্দুল মোমেন আদালতে আবেদন করেন এবং উপযুক্ত দাম দিয়ে তারা জমিটি কিনতে ইচ্ছুক বলে আদালতকে অবহিত করেন। এর প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত বিক্রি করা সম্পত্তির খতিয়ান সৃজনের বিষয়ে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন।

এ বিষয়ে আবদুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নিজে ভূমি অফিসে গিয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। একই সঙ্গে আদালতের নিষেধাজ্ঞার কপিও দিয়েছি। তখন খতিয়ান সৃজন করা হবে না বলে আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন এসিল্যান্ড আতিকুর রহমান এবং অন্য কর্মকর্তারা। কিন্তু মোটা অংকের টাকা লেনদেন করে অথবা অনৈতিক অন্য কোনো সুবিধা পেয়ে এসিল্যান্ড আতিকুর এখান থেকে বদলি হওয়ার ঠিক আগে তড়িঘড়ি করে খতিয়ান সৃজন করে দিয়ে যান। এর মাধ্যমে তিনি সুস্পষ্টভাবে আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করেছেন।

এ বিষয়ে বাকলিয়া সার্কেল সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের অফিস সহকারী শুভ ঘোষের কাছে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ গ্রহণের রেজিস্ট্রার খাতা যাচাই করে দেখেন। ওই খাতায় দেখা যায় আবদুল মোমেনের কাছ থেকে ২৭ জুলাই ২০২২ তারিখে লিখিত অভিযোগটি গ্রহণ করা হয়। তহসিলদার অফিসে ৩৭৩ নম্বর ডকেটে এখনো অভিযোগটি রয়েছে। একই সঙ্গে সৃজন হওয়া খতিয়ান তিনটি অনলাইনে যাচাই করে দেখা যায় তিনটি খতিয়ানই সৃজন হয়েছে ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট।

অভিযোগের বিষয়ে বাকলিয়া সার্কেলের তৎকালীন এসিল্যান্ড ও বর্তমান বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি এখন বরিশালে কাজ করছি। আমার সব বিষয় মনে নেই। আপনি (এই প্রতিবেদক) একটু এসিল্যান্ড কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেন।’

অভিযুক্ত সাবেক এসিল্যান্ড মোহাম্মদ আতিকুর রহমান

এসিল্যান্ড কার্যালয়ে গিয়ে ‘অভিযোগ গ্রহণের পর খতিয়ান সৃজন’ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘অভিযোগ রিসিভ হলেও হয়তো আমার কাছে পৌঁছায়নি। আমি জানলে এভাবে খতিয়ান সৃজন হওয়ার কথা নয়। আমি কীভাবে আন্তরিকভাবে লোকজনকে সেবা দিয়েছি ওই এলাকায় একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন।’

অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সুবিধা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তারপরও কোনো সমস্যা হলে ভুক্তভোগী ব্যক্তি বর্তমান এসিল্যান্ড বরাবর আবেদন করতে পারেন। তিনি যাচাই-বাছাই করে সমাধান করে দেবেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাকলিয়া সার্কেলের বর্তমান এসিল্যান্ড এস এম এন জামিউল হিকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এসব খতিয়ান আমার সময়ে হয়নি, আগের কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন। তবে এটি খুব জটিল বিষয় নয়। সৃজন হওয়া খতিয়ানের বিষয়ে আপত্তি থাকলে ভুক্তভোগী ব্যক্তি পুনরায় অভিযোগ করতে পারবেন। এ ঘটনায় আদালতের নিষেধাজ্ঞা ছিল কি না তা যাচাই করা হবে। যদি নিষেধাজ্ঞা থাকে তাহলে ওই তিন খতিয়ান বাতিল করা হবে।’

এমআর/এমজে