অপপ্রচারকারীদের শাস্তি না দিয়ে বই প্রত্যাহার অপ্রত্যাশিত
শিক্ষাক্রম নিয়ে ছড়ানো বিভিন্ন অপপ্রচার ও গুজবের ঘটনা বিচ্ছিন্ন মনে হলেও প্রতিটি ঘটনা সাম্প্রদায়িকতার একই সুতোয় গাঁথা। এগুলো অত্যন্ত সু-পরিকল্পিতভাবে সম্প্রীতি ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করার অপচেষ্টা। এসব অপপ্রচারের ঘটনায় প্রকৃত অপরাধী কারা তা জানা সত্ত্বেও তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে না। উল্টো অপ্রত্যাশিতভাবেই কোনো আলোচনা ছাড়াই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুইটি বই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও সমতাভিত্তিক, শিক্ষা পাঠ্যক্রম বিষয়ক অপপ্রচার বন্ধ হোক’ বিষয়ক গোল টেবিল বৈঠকে লিখিত বক্তব্যে এ কথা বলে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি।
বিজ্ঞাপন
লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ওয়াই ডব্লিউ সিএ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হেলেন মনীষা সরকার। এসময় শিক্ষাক্রম নিয়ে ছড়ানো বিভিন্ন অপপ্রচার ও গুজবের ঘটনার অংশবিশেষ উপস্থাপন করেন তিনি। বলেন, বিষয়বস্তু অপরিবর্তিত রেখে নতুন পাঠ্যপুস্তকে যেসব ভুলত্রুটি রয়েছে তা সংশোধন করে দ্রুত পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে হবে।
বৈঠকে মডারেটর হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সেখানে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান বলেন, মুখস্ত নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে এবার সৃজনশীল চিন্তনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করতে দুই বছরব্যাপী গবেষণার পর ২০১৯ সালে এই শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এবারের শিক্ষাক্রমে সমস্যা চিহ্নিত, সমস্যা উত্তরণের উপায়, অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করা, বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান দেখানো, নিপীড়িত গাষ্ঠীর মানুষকে মর্যাদা দিতে শেখার মতো মানসিক অবস্থা তৈরির জন্য শিক্ষা উপকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সরকারের প্রতি মৌলবাদী গোষ্ঠীকে কঠোরভাবে দমন করার জোরালো দাবি জানান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, মৌলবাদীদের সঙ্গে সমঝোতা করে বিজ্ঞান ও ইতিহাসের পাঠ্যক্রম পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাধারণ কারিকুলাম নিয়ে যত কথা হয় মাদ্রাসার কারিকুলাম নিয়ে কখনো কথা হয় না।
তিনি আরও বলেন, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ধর্মকে নিজ নিজ জায়গায় থাকতে দিতে হবে। ৫ম থেকে-৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ পাঠ্যক্রম থাকতে হবে।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, আমাদের মাইন্ডসেট এনালিটিক্যাল না। এর ফলে নানা প্রতিবন্ধকতা আসছে। এসময় তিনি দক্ষ ও যুক্তিশীল মনোভাবের জনগোষ্ঠী তৈরি করার লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও মানবাধিকার শিক্ষার ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের জেন্ডার সংবেদনশীল মনোভাব তৈরির জন্য জেন্ডার সমতা বিষয়ক প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাতে বাধা দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ছড়ানো বিদ্বেষকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাস্তবায়নে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, শিক্ষা পাঠ্যক্রম নিয়ে বিতর্ক আসলে অজ্ঞানতার মূল দ্বন্দ্বকে উপস্থাপন করে। সমাজ আজ যে অবস্থানে রয়েছে, সেখানে পরিবর্তন নষ্ট করার আয়োজন বন্ধ করতে প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ। সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার আগে সরকারকে কারিকুলাম পর্যালোচনা করতে হবে। ধর্ম শিক্ষাকে একমুখী করতে হবে। খুব শক্তভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তনকে লক্ষ্যায়িত করতে হবে।
মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, শিক্ষাক্রম চাহিদার সঙ্গে বিবেচনায় রেখে সর্বদাই পরিবর্তনশীল। সরকারকে নীতিমালা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে। দৃঢ়ভাবে সমঝোতার ক্ষেত্রে কতটুকু সমঝোতা করা হবে তার কৌশল সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। তিনি বিতর্কিতের ইস্যুকে উপেক্ষা করে শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
অতিথিদের আলোচনা শেষে অনুষ্ঠিত মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন দি হাঙ্গার প্রজেক্টের দিলিপ সরকার, ব্লাস্টের মাহবুবা আক্তার, বাউসির মাহবুবা বেগম, আইন ও শালিস কেন্দ্রের রাখী জামান।
গোল টেবিল বৈঠকে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্যদের মধ্যে অ্যাকশন এইড, দীপ্ত ফাউন্ডেশন, উইমেন ফর উইমেন, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, আইন ও শালিস কেন্দ্র, ঢাকা ওয়াইডব্লিউ সি এ অব বাংলাদেশ, কর্মজীবী নারী, নারী মুক্তি সংস্থা, পল্লীমা মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেতাকর্মীসহ প্রায় শতাধিক লোক উপস্থিত ছিলেন।
জেইউ/কেএ