ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ।

তিনি বলেছেন, কোনো গার্ড নেই, অস্ত্র নেই, পুলিশকে আগে থেকে অবগত না করেই সেদিন ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এতগুলো টাকা বহন করছিল মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিদিন তাদের চার-পাঁচটা গাড়ি এভাবে নিরাপত্তা ছাড়াই চলাচল করছিল। তাদের দুই-তিন জন গানম্যান আছেন যারা অফিসেই থাকেন। অধিকাংশ সময়ই তারা থানা পুলিশকে অবহিত করেন না।

রোববার (১২ মার্চ) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ডিবি প্রধান।

তিনি বলেন, উত্তরার তুরাগ এলাকায় ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের সোয়া ১১ কোটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আমরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করছি। এখনো অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ঘটনা পর্যালোচনার তথ্য তুলে ধরে হারুন-অর-রশীদ বলেন, গ্রেপ্তারদের তথ্য ও মানি প্ল্যান্টের কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, ১১ কোটি টাকা পরিবহনের সময় নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা অর্থাৎ গার্ডের জন্য অস্ত্রসহ কোনো নিরাপত্তা কর্মী ছিল না। অধিকাংশ সময় এভাবে অধিক টাকা পরিবহন হয়, যা পরিবহনকৃত টাকা নিরাপত্তার বিধানে অপ্রতুল।

ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্ল্যান্ট লিংকের কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন, ছিনতাইয়ের শিকার গাড়িটির পেছনে তাদের আরেকটি গাড়িতে সিকিউরিটির লোকজন ছিল। এর সত্যতা আপনারা পেয়েছেন কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কিন্তু তাদের সিকিউরিটির লোকজনকে থানায় এনেছিলাম। তারা কিন্তু স্বীকার করেছেন, তাদের দুজন সিকিউরিটির লোক আছেন, তারা অফিসেই থাকেন, ঘটনার সময় তারা গাড়িতে ছিলেন না। যদি থাকতই তাহলে তো ডাকাতরা যখন ধাক্কা দিল, দরজা খুলে নামালো তারা  ধস্তাধস্তি, মারামারিও করলেন না। তাদের একজন দূরে গিয়ে নেমে গেলেন, কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করলেন না। অস্ত্র থাকলে তো গুলি করতেন, কিছুই করলেন না।

ডিবি প্রধান বলেন, ডিবির অভিযান চলমান রয়েছে। ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বাকি টাকা উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছি। জিজ্ঞাসাবাদে এসব ব্যাপারে জানতে চাওয়া হবে।

আরও পড়ুন : উত্তরায় ব্যাংকের টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় তুরাগে মামলা

গ্রেপ্তারদের সঙ্গে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্ল্যান্ট লিংকের কারো যোগসাজশ বা যোগাযোগ ছিল কি না— জানতে চাইলে হারুন বলেন, আমরা এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি, সাক্ষ্য নিচ্ছি, গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত আছে। মানি প্ল্যান্ট লিংক যে পরিমাণ টাকা ট্রাঙ্কে থাকার কথা বলেছে সেটাও ছিল কি না তা তদন্ত করছি। তারা যে এত পরিমাণ টাকা লেনদেন বা বহন করছিল তা থানাকে জানায়নি, এতদিন যাবত তারা যে বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা লেনদেন করেন কোনো দিন তারা থানা পুলিশকে অবহিত করেনি। এর সব কিছু আমরা তদন্ত করছি।

যাদের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার করলেন তাদের পরিচয় কী, তারা পেশাদার ডাকাত কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আপাতত এ ব্যাপারে কিছু জানাচ্ছি না। যেহেতু আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। অভিযানের স্বার্থেই বলছি না।

টাকার গাড়িতে থাকতে পারে ডাকাতদের ইনফর্মার, সন্দেহ মানি প্ল্যান্টের

যোগাযোগ করা হলে মানি প্ল্যান্ট লিংকের পরিচালক অজয় কর ঢাকা পোস্টের কাছে টাকা বহনকারী গাড়িতে গানম্যান না থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, সেদিন সত্যিই টাকা বহনকারী গাড়িতে আমাদের গানম্যান ছিল না। তবে সিকিউরিটির লোকজন ছিল। ডাকাত দলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি, মারামারিও হয়েছে। ডাকাত দল আমাদের গাড়ির দরজাও ভেঙ্গে ফেলেছে।

অজয় কর বলেন, এটাও সত্যি আমরা এত টাকা বহন করার ক্ষেত্রে পুলিশকে জানাইনি। সাধারণত জানানোও হয় না। কারণ, এটা আমাদের রেগুলার একটিভিটিজ। সপ্তাহে পাঁচ দিনই এ কার্যক্রম চলে। রেগুলার একটিভিটিজের কারণে পুলিশকে জানানো হয়নি। শুধু আমরা না, অন্য প্রতিষ্ঠানও জানায় না।

কেন টাকা বহনকারী গাড়িতে গানম্যান ছিল না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেলারির টাইমে আমাদের সিডিউলে ব্যাপক প্রেসার পড়ে। প্রেসারের কারণে সিডিউলের বাইরে গিয়েও আমাদের ডিপ্লয়মেন্ট করতে হয়। এর বাইরে আমাদের অ্যারেঞ্জমেন্ট ঠিকই থাকে।

আরও পড়ুন : ছিনতাইয়ের ৯ কোটি টাকা উদ্ধার, মানি প্ল্যান্টের পরিচালকসহ আটক ৭

মানি প্ল্যান্ট লিংকের পরিচালক বলেন, অতিরিক্ত চাপের কারণে আমরা ওই টাকার গাড়িতে গানম্যান দিতে পারিনি। যথাসময়ে টাকা পৌঁছাতে না পারলে আবার পেনালটির বিষয় থাকে। কাস্টমারদের যথাযথ সার্ভিস দেওয়ার ব্যাপার থাকে।

এত সকালে কেন রুট হিসেবে ওই সড়ক বেছে নেওয়া হয়েছিল? সেখানে ঝুঁকি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি? জানতে চাইলে অজয় কর বলেন, মিরপুর ডিওএইচএস-এ আমাদের অফিস। সেখান থেকে মেট্রোরেলের নিচে দিয়ে তুরাগ পর্যন্ত যাওয়ার নতুন রাস্তা হয়েছে। গত ২-৩ মাস ধরে ওই সড়কটি ব্যবহার করা হচ্ছিল। এতে সময় সাশ্রয় হচ্ছিল। দ্রুত কাস্টমারের চাওয়া টাকাও পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছিল।

গানম্যান, সিকিউরিটি ছাড়া এত সকালে টাকা বহনের তথ্য আপনাদের গাড়ির কেউ বাইরে ফাঁস করেছিল কি না বা ডাকাত দলের সঙ্গে যোগসাজশ থাকতে পারে বলে সন্দেহ করেন কি না—  এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, এটা তদন্তাধীন বিষয়। ডিবি পুলিশ সেটা তদন্ত করছে। এখনো ডিবি পুলিশের দল আমাদের অফিসে অবস্থান করছে। তবে এটা তো ঠিক যে হুট করে তো কিছু ঘটে না। এমন ঘটনা হঠাৎ করে ঘটেনি। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া কেউ করতে পারে না। যারা ছিনতাই করেছে তাদের হয়ে টাকা বহনকারী গাড়িতে ইনফর্মার থাকতে পারে, যারা জেনে বুঝে এটি করেছে।

এদিকে রাজধানীর উত্তরার তুরাগ এলাকায় ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের সোয়া ১১ কোটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আরও দুই কোটি ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ। ঢাকার মিরপুর, বনানী, সুনামগঞ্জসহ ভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে এই টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে আট জনকে।

আগে উদ্ধার করা ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজারসহ এ নিয়ে মোট উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণ ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা।

আর গ্রেপ্তাররা হলেন— মো. সানোয়ার হাসান (২৮), মো. ইমন ওরফে মিলন (৩৩), মো. আকাশ মাদবর (২৫), সাগর মাদবর (২২), মো. বদরুল আলম (৩৩), মো. মিজানুর রহমান (২০), মো. সনাই মিয়া (২৮) ও এনামুল হক বাদশা (২৬)। তুরাগ থানায় দায়ের হওয়া এ সংক্রান্ত মামলা ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) সকালে রাজধানীর উত্তরা থেকে বেসরকারি ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী গাড়ি থেকে প্রায় সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। দিনের আলোতে রাস্তা থেকে নজিরবিহীন এ ছিনতাইয়ের ঘটনায় তাৎক্ষণিক মাঠপর্যায়ে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ছিনতাই হওয়া সোয়া ১১ কোটি টাকার মধ্যে বেশিরভাগ টাকা উদ্ধারের কথা জানায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

জেইউ/এসএসএইচ/