পনেরো বছর আগে ঝালকাঠি থেকে রাজধানীতে এসে তেজগাঁও কুনিপাড়া বস্তিতে স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস শুরু করেন রেহেনা। ১১ বছর ধরে এই বস্তিতে টেইলার্সের দোকান চালিয়ে সংসার গুছিয়েছিলেন স্বামী রফিকুল ইসলাম। কিন্তু রফিকুল-রেহেনার সেই সাজানো-গোছানো সংসার এক রাতের আগুনে পুড়ে ছারখার।

নিষ্ঠুর আগুনে পুড়ে গেছে টেইলার্সের দোকান, কাপড়-চোপড়, ভস্মীভূত সেলাইয়ের মেশিনও। ঘরের কোনও কিছুই বের করতে পারেননি রেহেনা। শুধু রেহেনা-রফিক নয়, আকস্মিক আগুনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে আরও অনেকে। আগুনে শুধু ঘর পোড়েনি, ধূসর করে দিয়েছে বস্তিবাসীর বাঁচার স্বপ্নও।

মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কুনিপাড়া বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো বস্তি। পুড়ে ভস্মীভূত বস্তিতে শুধু লোহা ও সিমেন্টে তৈরি খুঁটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। বাকি সব পুড়ে ছাই হয়ে মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। টিনের ঘরগুলো সব ভেঙেচুরে একাকার।

সেখানে দেখা যায়, রেহেনার মতো অনেকেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই খোঁজাখুঁজি করছেন, প্রয়োজনীয় কিছু অক্ষত আছে কি না। হয়তো ছাই ঘেঁটে সব হারানো যন্ত্রণা লুকাতে চাইছেন তারা।

নিজ ঘরের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা রেহানা ছল ছল চোখে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই বস্তিতে একটি বড় রুম ভাড়া নিয়ে অর্ধেকে স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করি। আর বাকি অংশে টেইলার্সের দোকান। আগুনে কোনো কিছু বাকি নেই। সব পুড়ে গেছে। এই যে দেখেন, পুড়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে সেলাই মেশিন। আমার সব শেষ’। এসব কথা বলতে বলতে তার গলা যেন ধরে আসছে। আর বের হচ্ছে কোনো শব্দ। নীরবে দু-চোখে বেয়ে পড়তে থাকলো ‘আগুনে পোড়া’ জল!

এ বস্তির শুধু রেহেনাই নয়, দুই শতাধিক নিম্ন আয়ের মানুষ এক আগুনে খুইয়েছেন সর্বস্ব। গোছানো সংসার, জমানো টাকা, সাধের অলংকার সব হারিয়েছেন তারা।

বরিশাল বাকেরগঞ্জ থেকে ১৫ বছর আগে এই বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া নূর ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিন হাজার টাকায় একটা রুম ভাড়া নিয়ে পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে এখানে থাকি। নিজে মিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাই।

নূর ইসলাম বলেন, বাইরে মিস্ত্রির কাজ করছিলাম, বস্তিতে ফেরার পথে শুনি আগুন লাগছে। দৌড়ে এসে দেখি আমার ঘর আগুনে জ্বইলা যাইতেছে। ঘরে বা বস্তিতে ততক্ষণে ঢোকার মতো অবস্থা ছিল না। আগুনের সময় স্ত্রী-সন্তান ঘরেই ছিল। কয়েক মিনিটের জন্য বাইচ্চা গেছে। বস্তির তিন তলায় ছিল ঘর। নিচে নাইম্মা রান্না করছিল। ঘরে আইসা দেখে পাশের ঘরে আগুন জ্বলতাছে। কোনো রকম বাচ্চা নিয়া নাইম্মা পড়ছে।

নূর ইসলাম বলেন, যে ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত তারা কেউই ঘরে ছিল না। তালাবদ্ধ ছিল। বস্তিতে তিন মালিকের আলাদা ঘর। আমার মালিকের ভাড়া দেওয়া ৭৮টা ঘর পুড়ছে শুনতাছি।

নিজের ঘরের গলিতে চিন্তিত অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায় মুক্তা আক্তারকে। বি-বাড়িয়া থেকে আট বছর বয়সে এই বস্তিতে আসেন বাবা-মায়ের হাত ধরে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বস্তিতেই সংসার পেতেছেন মুক্তা।

তিনি বলেন, স্বামী মো. মানিক বার্জার কোম্পানিতে কাজ করে। আগুনের সময় ঘরেই ছিলাম। আগুন বেড়ে যাওয়ায় ঘর ছেড়ে বটতলায় গিয়ে আশ্রয় নিই। সবই পুড়ে গেছে। ভাবছিলাম অন্তত স্টিলের আলমারিতে থাকা গহনা টাকা হয়তো থেকে যাবে। আইসা দেখি সব চুরি হয়ে গেছে।

হেলাল উদ্দিন আহমেদের মালিকানা বস্তির একাংশের দেখভাল করেন ম্যানেজার জাকির হোসেন।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৩৮টা ঘর। আগুনের সময় আমি বস্তিতেই ছিলাম। বস্তির উত্তর পাশে তালাবদ্ধ দুটি ঘরে প্রথমে আগুনের সূত্রপাত হয়। চিল্লাচিল্লি শুরু হলে আমি বের হয়ে ওইপাশে যাই। এরপর দুইটা ঘরের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকতেই দেখি সব দাউদাউ করে জ্বলছে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ৯৯৯ ফোন করে ফায়ার সার্ভিসকে আগুনের খবর দেই।

তিনি বলেন, গলি ছোট। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বস্তিতে ঢুকতে পারছিল না। আমরাও দশ-বারোজন মিলে পানি দিয়েও কাজ হচ্ছিল না। চারদিকে দাউদাউ করে জ্বলা শুরু হয়েছিল। তখনো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের কানেকশন সচল ছিল। দৌড়ে একে একে সব বন্ধ করি।

বস্তিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সবগুলো লাইন বৈধ দাবি করে তিনি বলেন, আগুন নেভাতে বড় বাধা ছিল সরু গলির পথ। এই পথই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে পারছি না। যে কারণে বিধায় যথাসময়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বস্তির তিনটি অংশ। হালিম আহমেদের ৩৮টা, হেলাল উদ্দিন আহমেদের ৭৮টা আর আক্কাস উদ্দিনের ২৫০ টা ঘর পুড়ে গেছে। ঘর প্রতি ভাড়া ২০০০ থেকে ৪ হাজার টাকা। কারও কারও দুই ঘর মিলে ভাড়া ৭ হাজার টাকাও। ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর দাবি, এসব ঘরের অধিকাংশগুলোই পুড়ে গেছে আগুনে।

ফায়ার সার্ভিসের তেজগাঁও স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার দেওয়ান মোহাম্মদ রাজিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতরাতেই ফায়ারের পরিচালক অগ্নিকাণ্ডের স্থানে ব্রিফিং করেছেন। বস্তির আগুনে আমরা যেহেতু ফাস্ট রেসপন্ডেড টিম। আমরা আগুন নেভানোর পর দেখেছি বস্তিতে বড় বড় ১১টি ঘর ছিল। সবগুলো আধাপাকা তবে তিন তলাবিশিষ্ট। এর ভেতরে আবার ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর ছিল। আমাদের হিসেবে দুইশর মতো ঘর পুড়ে গেছে আগুনে।

যোগাযোগ করা হলে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, তেজগাঁওয়ে কুনিপাড়া বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। তবে ক্ষয়ক্ষতি ও আগুনের কারণ অনুসন্ধানের বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষ জানা যাবে।

ফায়ার সা‌র্ভিসের উপ-প‌রিচালক (ঢাকা) দিনম‌নি শর্মা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এখনো আগুনের কারণ অনুসন্ধান করতে পারিনি। কথা বলেছি, তবে একেক জন একেক ধরনের তথ্য দেয়। তদন্ত সাপেক্ষে আগুনে কারণ স্পষ্ট হবে।

আগুন নেভাতে ব্যাপক বেগ পেতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা। অথচ এ শিল্প এলাকা বাণিজ্যিক আর আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। বস্তিতে ঢোকার পথ মাত্র তিন ফুটের। আমরা কোনও দিক দিয়ে বস্তিতে ঢুকতেই পারছিলাম না। পরে হাতিরঝিল সংলগ্ন পাশ দিয়ে টিনসেড চালার ওপরে ওঠে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করি। চারদিক দিয়ে প্রাচীর বেষ্টিত বস্তিটি অবৈধ বলেও দাবি করেন তিনি।

এখানে উল্লেখ্য, সোমবার (১৩ মার্চ) সন্ধ্যা ৭টা ৫২ মিনিটের দিকে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস।

ফায়ার সার্ভিসের মোট ১১টি ইউনিটের প্রচেষ্টায় রাত ১০টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানান সংস্থাটির সদরদপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম দোলন।

তেজগাঁওয়ের বস্তিতে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি দলও। সোমবার রাতে আইএসপিআর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।

জেইউ/এসএম