নিহত আবুল হাশেম (ছবি : সংগৃহীত)

চট্টগ্রাম সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়ায় মসজিদে এক খণ্ড জমি দান করা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধের জেরে খুন হন আবুল হাশেম। এ হত্যাকাণ্ডের এজাহার ও চার্জশিটভুক্ত আসামি মো. সেলিম। তিনি দীর্ঘ আট বছর পলাতক ছিলেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি বান্দরবান থেকে তাকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে প্রেরণ করে পুলিশ। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র এক দিনের মাথায় তাকে জামিন দেন চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ ফারজানা আকতার।

ওই জামিনের আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন— ‘আদালতে সেলিমের জামিনের আবেদন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জামিনের ঘোর বিরোধিতা করেন। মামলার এফআইআর, এজাহার ও জব্দ তালিকা ১৬১ ধারার জবানবন্দিসহ অন্যান্য কাগজাদি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়— এজাহারে আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। আসামি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। আসামিকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেনি। সহযোগী আসামিরা জামিনে আছেন। আসামি সেলিম সম্পূর্ণভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার। সার্বিক বিবেচনায় পাঁচ হাজার টাকা বন্ডে দুজন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির জিম্মায় আগামী ধার্য তারিখ পর্যন্ত তার অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করা হলো।’
 
এমন আদেশে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ৭ মার্চ জেলা জজ আদালতে একটি দরখাস্ত দেন বাদীপক্ষ। যেখানে তারা ফৌজদারি কার্যবিধি ৫২৬ (বি) ধারা মোতাবেক বিচারিক আদালতটি পরিবর্তনের আবেদন করেন। আবেদনটির শুনানি শেষে মামলার নথি তলব করেন আদালত।

এদিকে, ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের অনুসন্ধান, মামলার নথি ও আদালত পরিবর্তনের জন্য করা আবেদন সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২১ ডিসেম্বর ওই হত্যা মামলার আরেক আসামি রাশেদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করে সাতকানিয়া থানা পুলিশ। এজাহারভুক্ত এ আসামি মামলা দায়েরের পর থেকে পলাতক ছিলেন। পরে তাকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে আদালতে বাদীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাত বছর পলাতক থাকার পর গ্রেপ্তার হয়ে মাত্র ২৩ দিনের মাথায় ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ ফারজানা আকতারের আদালত থেকে তিনি জামিন পান। জামিনের আবেদন করেন তার ফুফাতো বোন অ্যাডভোকেট রহিমা আক্তার।

সর্বশেষ আসামি সেলিমের জামিনের বিষয়ে আদালতের দেওয়া আদেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। তারা জানান, বিচারক হিসেবে উনি জামিন দিতেই পারেন। তবে তিনি জামিনের আদেশে উল্লেখ করেছেন— হত্যাকাণ্ডে সেলিমের জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো নথিতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। বাস্তবে এফআইআর, এজাহার ও জব্দ তালিকায় ১৬১ ধারার জবানবন্দিসহ সব নথিতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে 

দ্রুত জামিন হওয়ায় আদালতে আত্মসমর্পণ করেন দীর্ঘদিন পলাতক থাকা রাশেদের নিকটাত্মীয় ও হত্যা মামলার অন্য আসামি তৌহিদুর রহমান। তিনিও সঙ্গে সঙ্গে চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ ফারজানা আকতারের আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান। এ নিয়ে আদালত অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এরপর আসামিরা এলাকায় বলাবলি করেন যে তাদের আইনজীবী রহিমা আক্তার ও বিচারক ফারজানা আকতার দুজনে বান্ধবী। সর্বশেষ একই আদালত থেকে গ্রেপ্তারের মাত্র এক দিনের মাথায় জামিন পান হত্যা মামলার আলোচিত আসামি সেলিম।

এর নেপথ্যের কারণ হিসেবে জানা যায়, আইনজীবী রহিমা আক্তার ও বিচারক ফারজানা আকতার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একই ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

সর্বশেষ আসামি সেলিমের জামিনের বিষয়ে আদালতের দেওয়া আদেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। তারা জানান, বিচারক হিসেবে উনি জামিন দিতেই পারেন। তবে তিনি জামিনের আদেশে উল্লেখ করেছেন— ‘হত্যাকাণ্ডে সেলিমের জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো নথিতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। বাস্তবে এফআইআর, এজাহার ও জব্দ তালিকায় ১৬১ ধারার জবানবন্দিসহ সব নথিতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।’

নথিগুলোতে সেলিমের বিষয়ে বলা হয়— ‘ঘটনার দিন আবুল হাশেম ও আবু মুছা সিকদারকে সেলিমসহ অন্যান্য আসামিরা মিলে মারধর করেন। পরে ভুক্তভোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার পথে মাহালিয়া আমতলী ব্রিজের ওপর গাড়ি আটকে ফেলেন সেলিম ও মামলার অপর আসামিরা। এ সময় মামলা দায়ের করলে মেরে ফেলা হবে বলে আহতদের হুমকি দেন সেলিম ও তার সহযোগীরা। এরকম সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও সেটি আমলে নেননি আদালত।’

এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী রহিমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার আত্মীয় রাশেদকে আমি জামিন করিয়েছি। তবে তিনি জেল খেটেছেন। চার্জশিটে তাকে বাদ দিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুপারিশ করেছেন। যদিও কোর্ট তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিয়েছেন। বিষয়টি আমরা আইনিভাবে মোকাবিলা করব। তাছাড়া বাকি আসামিদের জামিনের বিষয়ে আমার কোনো হাত নেই।’

আসামি তৌহিদের জামিনের দিন তিনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন— এমন প্রশ্নের জবাবে এ আইনজীবী বলেন, ‘ওই দিন মামলার তারিখ ধার্য ছিল। এজন্য আমি আদালতে গিয়েছিলাম।’

মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী জালাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আট বছর পলাতক থাকা এক আসামিকে এক দিনেই জামিন দেওয়া হয়েছে। আবার ওই জামিনের আদেশে বলা হয়েছে, আসামি নির্দোষ। তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। বাস্তবে একজন বিচারকের এসব লেখার এখতিয়ার নেই। আবার আসামিপক্ষের এক আইনজীবী ও ওই বিচারক ক্লাসমেট। এজন্য আমরা আবুল হাশেম হত্যা মামলা বিচারের জন্য আদালত পরিবর্তনের আবেদন করেছি।’

মামলার বাদী আবু মুছা সিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আসামি রাশেদ ও তৌহিদের জামিন হলে এলাকায় তারা অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের জামিনের আদেশের ব্যাপারে আমরা উচ্চ আদালতে যাইনি। কারণ, আমার মারা যাওয়া ভাইয়ের সন্তান ও স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে হয়। পাশাপাশি মামলাটি পরিচালনা করতে আমাদের অনেক খরচ হয়। এজন্য চাইলেও সব বিষয়ে আমরা উচ্চ আদালতে যেতে পারছি না। তবে, সেলিমকে আমরা অনেক চেষ্টা করে গ্রেপ্তার করিয়েছি। তাকে মাত্র এক দিনের মাথায় জামিন দিয়ে দিল। এজন্য আমরা আদালত পরিবর্তনের আবেদন করেছি। কারণ, ওই আদালতে আমরা বিচার পাব না।’

‘জেলা জজ আদালত পরিবর্তনের আদেশ না দিলে আমরা বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে যাব। উচ্চ আদালত ছাড়া আমাদের আর কোনো গতি থাকবে না।’

আদালত সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি সাতকানিয়ার বাজালিয়া ইউনিয়নে মসজিদ ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসার ওয়াকফ করা (দান করা) জায়গা নিয়ে বিরোধের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। এতে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত আবুল হাশেম ও আবু মুছা সিকদারকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিইউতে কয়েক দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৩ জানুয়ারি আবুল হাশেম মারা যান।

ওই ঘটনায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে সাতকানিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের বড় ভাই মসজিদ কমিটির সভাপতি আবু মুছা সিকদার। মামলাটি তদন্ত করেন সাতকানিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ফজলুল হক। ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১০ জনকে আসামি ও সাতজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে চট্টগ্রাম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে, আদালতে অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দেন মামলার বাদী। সেই আবেদন গ্রহণ করে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেন আদালত। 
সংস্থাটির চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটে কর্মরত পরিদর্শক আবু জাফর মো. ওমর ফারুক মামলাটির তদন্ত করেন। তিনি ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে আরও তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন আদালত।

বর্তমানে আদালতে আসামি মোস্তাফিজুর রহমান, আমিনুর রহমান, হারুন অর রশিদ, মো. সোলায়মান, জাফর আহমেদ, আতিকুর রহমান, মুজিবুর রহমান, মো. জাকারিয়া, বজলুর রশিদ, মাহফুজুর রহমান, মাশুকুর রহমান, মো. সেলিম, তৌহিদুর রহমান, রাশেদ হোসেন ও মো. আনোয়ারসহ মোট ১৫ জনের বিরুদ্ধে বিচার চলমান আছে।

খুনের উদ্দেশে অপহরণ করা হয় নিহতের ভাই আবুল কাশেমকে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে চাকরি করেন আবুল কাশেম। তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার আবুল হাশেমের ভাই। ভাই হত্যার বিচার চেয়ে তিনি আট বছর ধরে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মামলার তদন্ত ও আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশকে সহায়তা করেছেন তিনি। মামলা নিয়ে বেশি দৌড়াদৌড়ি করায় তাকেই টার্গেট করে আসামিরা। ২০১৬ সালের ৯ জানুয়ারি তাকে হত্যার উদ্দেশে অপহরণ করেন আসামি সেলিম ও তার সহযোগীরা। তবে সেবার কোনোমতে প্রাণে বাঁচেন আবুল কাশেম। এ নিয়ে ঘটনার পর দিন সাতকানিয়া থানায় আরেকটি মামলা দায়ের হয়।

২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর মামলাটির তদন্ত শেষে খুনের উদ্দেশে অপহরণের অভিযোগে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এতে রাশেদ হোসেনসহ মোট সাতজনকে আসামি করা হয়। কাকতালীয়ভাবে মামলাটি বিচারের জন্য চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ ফারজানা আকতারের আদালতে চলে আসে।

এ ব্যাপারে অপহরণ মামলার বাদী আবুল কাশেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভাইয়ের মামলা নিয়ে তৎপরতা চালানোয় আমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। এতে রাশেদকে প্রধান আসামি করা হয়। আবার রাশেদের ফুফাতো বোন হচ্ছেন অ্যাডভোকেট রহিমা আক্তার। তিনি এবং ওই আদালতের বিচারক ফারজানা আকতার বান্ধবী। আমার ভাই হত্যা মামলায় আদালতটি থেকে যা আদেশ দেওয়া হচ্ছে তাতে কতটুকু বিচার পাব তা নিয়ে সন্দেহে আছি।
 
হুমকি দেওয়া হয়েছিল আবু মুছা সিকদারকে ও আবুল কাশেমকে
 
২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টার দিকে মসজিদ থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন আবু মুছা সিকদার ও আবুল কাশেম। এদিন হত্যা মামলার আসামি আমিনুর রহমান ওরফে খুইল্ল্যা, মোস্তফিজুর রহমান, জাফর আহমদ, মাহফুজুর রহমান, হারুনুর রশিদ ও অপহরণ মামলার আসামি দেলোয়ার হোসেন মিলে দুই ভাইয়ের গতিরোধ করেন। এ সময় দুই ভাইকে হত্যা ও অপহরণ মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেন তারা।

ওই ঘটনার দুই দিন পর ১৭ আগস্ট সাতকানিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন আবু মুছা সিকদার। এ প্রসঙ্গে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শুধু একবার নয়, আসামিরা অসংখ্যবার আমাদের মামলা তুলে নেওয়া জন্য হুমকি দিয়েছে। এখনও প্রতিনিয়ত আসামিরা আমাদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। জানি না সুষ্ঠু বিচার পাব কি না।’

এমআর/কেএ