রং উঠে গেছে অনেক আগে, দুই পাশে অজস্র ঘষাঘষির দাগ; পেছনের ভেঙে যাওয়া অংশে লাগানো আছে আলাদা পাত; সিটগুলো যেমন নোংরা তেমন ভাঙা ও সরু; গরমে ভরসার ফ্যানগুলো নষ্ট আর জানালার কাঁচগুলো ভেঙে ঝুলে আছে; পেছনে নেই ইন্ডিকেটর লাইট...

রাজধানী ঢাকার রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ানো সিটি বাসগুলোর একটির চিত্র এটি। প্রতিবেদন করার প্রয়োজনে অনেকগুলো বাস ঘুরে বেশিরভাগের ক্ষেত্রে এই একই চিত্র দেখা গেছে। অধিকাংশ বাসের দশাই এমন বেহাল। অনেক বাসে নেই নাম্বার প্লেটও।

বাসের দশা এমন বেহাল হলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে পিছিয়ে নেই কেউ। যাত্রীদের দাবি, রাজধানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে সর্বোচ্চ ভাড়া দিয়ে সর্বনিম্ন সেবা পাচ্ছেন তারা।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দেশে যাত্রী সেবাটা একেবারেই অবহেলিত। যাত্রীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া দিলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পান না।

অভিযোগ রয়েছে, যাত্রীরা এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করলে হেনস্তা, অপমানসহ শারীরিক নির্যাতনের মতো ঘটনার শিকার হন। অনেক ঘটনা হত্যাকাণ্ড পর্যন্তও গড়ায়। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই চুপ থাকেন দায়িত্বে থাকা মানুষজন। 

এখন পর্যন্ত ৫৯ পরিবহন কোম্পানির ৩ হাজার ৩০৭টি বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করতে সক্ষম হয়েছে মালিক সমিতি। বাকি আছে প্রায় ৩৮ কোম্পানির ২ হাজারেরও বেশি বাস।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন (২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত) বলছে, ঢাকার গণপরিবহনে প্রতিদিন ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া নৈরাজ্য হচ্ছে। গত বছরে দুইবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয় ভাড়া। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় যাত্রীদের সঙ্গে ২৫টি লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। হত্যার শিকার হয় ১৪ যাত্রী আর গুরুতর আহত হন ১০ যাত্রী। যেসব ঘটনা যাত্রী সাধারণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার তৈরি করেছে।

ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কিছুটা নড়েচড়ে বসে রাজধানীতে চলাচল করা বাস মালিকদের সংগঠন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। সংগঠনটি ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকাতে ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থার প্রবর্তন করে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৫৯ পরিবহন কোম্পানির ৩ হাজার ৩০৭টি বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করতে সক্ষম হয়েছে মালিক সমিতি। বাকি প্রায় ৩৮ কোম্পানির ২ হাজারেরও বেশি বাস।

এ ব্যবস্থাকে যাত্রীরা স্বাগত জানালেও বাসের কন্ডাক্টরদের পয়েন্ট অব সেল (পিওএস) মেশিন ব্যবহারে অনীহা দেখা গেছে। যাত্রীরা বলছেন, সময় ও ভাংতির দোহাই দিয়ে মেশিন ব্যবহার করতে চান না বাস কন্ডাক্টররা।

বাসে চড়ে প্রতিদিন কাজীপাড়া থেকে নীলক্ষেত এলাকায় যাতায়াত করেন বেসরকারি চাকরিজীবী জাহিদ আহসান। গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ ক্ষুব্ধ তিনি।

অনেকটা ক্ষোভ নিয়েই ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, সেফটি ও সুপার লিংক বাস ব্যবহার করে আমি অফিসে যাতায়াত করি। চার্টে কাজীপাড়া থেকে ঢাকেশ্বরী মন্দির পর্যন্ত ভাড়া দেখায় ২৬ টাকা। অথচ বাসগুলো ভাড়া নেয় ৩০ টাকা করে। তাদের প্রিন্ট করা টিকিটে কখনও ২৮ টাকা আবার কখনও ৩০ টাকা দেখায়। ২৮ টাকা দেখালেও ভাড়া ৩০ টাকাই নেয়। কনডাক্টররা বলে, তাদের কাছে ভাংতি টাকা নেই। পিওএস মেশিন ব্যবহারেরও সময় নেই।

এরপর প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, তাদের মেশিন ব্যবহারে এতো অনীহা, তাহলে মেশিন ব্যবস্থা আনা হলোই কেন? এটা কি শুধু আইওয়াশ মাত্র?

মালিক সমিতি অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে সোচ্চার হলেও পরিবহনের নাজুক অবস্থার দিকে নজর দিতে পারেনি। তারা বলছেন, আপাতত ভাড়া আদায়ের বিষয়টাই দেখছি। সব তো আর একসঙ্গে করা যাবে না।

পরিবহনের এমন নাজুক অবস্থা নিয়ে ২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর এক জরুরি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ঢাকায় সিটিতে চলাচলরত গণপরিহনের সৌন্দর্যের ওপর নগরের সৌন্দর্য ও দেশের ভাবমূর্তি অনেকাংশে নির্ভর করে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিছু বাস, মিনিবাসের রঙচটা, জরাজীর্ণ, জানালা-দরজার কাচ ভাঙা, সামনে পেছনের লাইট ভাঙা। কোনো কোনো বাস থেকে কালো ধোয়াও নির্গমন হচ্ছে। তাছাড়া কিছু বাস-মিনিবাসের ভেতরে ফ্যান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ভাঙা ও অচল। বেশিরভাগ বাসের সিটের কভারও অপরিষ্কার। যাত্রীদের চলাচলে নানাবিধ ভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।

এজন্য সংশ্লিষ্ট মোটরযান মালিকদেরকে আগামী ৩০ নভেম্বর মধ্যে যানবাহন ত্রুটিমুক্ত করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। অন্যথায় ৩০ নভেম্বরের পর এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সেসময় বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, মাত্র ৪ জন ম্যাজিস্ট্রেট রোস্টারিংয়ের মাধ্যমে ত্রুটিমুক্ত বাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন।

গণবিজ্ঞপ্তির পর ৩০ নভেম্বর পার হয়ে গেলেও কার্যকরী কোন ব্যবস্থা দেখা যায়নি। অভিযোগ উঠেছে, বিআরটিএর নিয়ম নীতির কোনো পাত্তা দেয়নি বাস মালিকরা। সড়কে আগের মতোই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অপরিষ্কার, অস্বাস্থ্যকর ও ত্রুটিযুক্ত বাসগুলো।

এ বিষয়ে মাহাদি হাসান নামের এক যাত্রী বলেন, ভাড়া ২/৪ টাকা বেশি নিচ্ছে নিক, সেটি নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু সার্ভিসটা তো ভালো দিবে। গরমের দিন আসছে। কিন্তু বাসের ভেতরে ৫টি ফ্যান থাকলেও তার মধ্যে ২টি বা ৩টি ফ্যান সচল। বাকিগুলো কবে, কখন নষ্ট হয়েছে তার কোনো ঠিক নেই। রাতে ফেরার পথে দেখা যায় বাসের ভেতর মাত্র ২/৩টা বাতি জ্বলে। বাসের সিটগুলোও ছোট। পা ঠিকভাবে রেখে বসার সুযোগ নেই। ভাড়া বেশি নিলেও অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া থেকে বিরত থাকে না বাসগুলো। তখন আবার নানা ছুতো দেখিয়ে কনডাক্টররা পিওএস মেশিনের টিকিটও দিতে চায় না।

আরেক বাস যাত্রী জাবির রহমান বলেন, ভাড়ার চার্টে থাকা স্টপেজগুলো শুধুমাত্র ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রেই কার্যকর। কিন্তু যাত্রী উঠানোর বেলায় কোনো স্টপেজ থাকে না। যাত্রী সেবা দেওয়ার চেয়ে ভাড়া আদায়টাই যেন বাস মালিকদের কাছে মুখ্য বিষয়।

এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্বের সব দেশে আমার যাওয়ার সুযোগ না হলেও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরেছি। এসব দেশের মধ্যে পার্থক্য করলে দেখা যায়- এশিয়ার শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাড়া ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি বাস সার্ভিসে। আর সেবার মানের দিক থেকে সবচেয়ে নিম্নমান এই দুই শহরেই। অর্থাৎ সর্বোচ্চ মূল্যে ভাড়া পরিশোধ করে সর্বনিম্ন যাত্রী সেবাটা আমরা পাচ্ছি।

সরকার বাস মালিকদের নানা প্রণোদনা দিয়ে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণের টাকায় রাস্তা নির্মাণ হয়, রাস্তার উন্নয়ন হয়, ব্রিজ নির্মাণ হয়। যদি অন্য কোনো ব্যবসার সাথে পরিবহন ব্যবসার তুলনা করেন, তবে সবচেয়ে কম খরচের ব্যবসা এটি। কারণ আপনার একটি দোকানের ব্যবসা করতে গেলে সেখানের সব অবকাঠামো নিজেকে করতে হয়। কিন্তু পরিবহনের ক্ষেত্রে সব ডেকোরেশন জনগণের টাকায় হয়। এখানে আপনি একটি বাস কিনে রাস্তায় নামিয়ে দিলেন, আপনার ব্যবসা শুরু হয়ে গেল। আর জনগণের ডেকোরেশন করে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, জনগণকে ভালো একটি সার্ভিস দেওয়া। কিন্তু সেই সার্ভিসটিই থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন জনসাধারণরা।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহনের স্টেকহোল্ডার চারজন। মালিক, শ্রমিক, যাত্রী বা জনগণ এবং সরকার। বর্তমান স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে আছে মালিক, শ্রমিক ও সরকারের। মধ্যে থেকে বাদ পড়েছে জনগণ। তাই জনগণের ভোগান্তির কথা কেউ আর শোনার নেই, কথা বলারও কেউ নেই।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব আরও জানান, ২০১২ সালে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজধানীতে ২০ বছরে ঊর্ধ্বে যেসব বাস রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ সেই বাসগুলোকে উচ্ছেদ করা হবে। ওই ২০ বছরের সঙ্গে আরও ১০ বছর হয়ে গেছে। এই ৩০ বছরে একটি বাসও উচ্ছেদ করতে পারেনি সরকারের এই শক্তিশালী সংস্থা।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে যাত্রী সেবাটা একেবারেই অবহেলিত। একই বাসে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন আর বসে আছেন, দুজনেই সমান ভাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু সেবাটা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। ভাঙ্গা জানালা দিয়ে শীতকালে বাতাস, বৃষ্টির সময় পানি ঢোকে। গরমকালে ফ্যানগুলো নষ্ট থাকে। যার ফলে আমাদের এখানে যাত্রী সেবাটা মুখ্য হয় না। শুধু ভাড়াটাই মুখ্য হয়। যাত্রী সেবার মানটাও যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা কখনও তারা ভাবেই না।

তিনি আরও বলেন, কিছু এসি বাস আছে যেগুলো ভাড়া একটু বেশি নিচ্ছে। তাদেরগুলো না হয় কিছুটা ঠিক আছে। কিন্তু রাজধানীর ৯৫ শতাংশ বাস নন এসি। এই ৯৫ শতাংশ বাসেই যাত্রী সেবাটা ঠিকমতো দেওয়া হয় না। একজন যাত্রী যখন ভাড়া দেয়, তখন ন্যূনতম কিছু সেবা তো অবশ্যই তার পাওয়া উচিত। কিন্তু সেটা যদি না দেওয়া হয়, তবে এজন্য বিআরটিএকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, যাত্রীবান্ধব পরিবেশ এবং অন্যান্য সবগুলো বিষয় একসঙ্গে সমাধান করতে পারব না। প্রথমে সঠিক ভাড়াটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছি। তারপর আমরা অন্য কাজে নজর দিব।

৩৬ সিটের ছোট বাসকে ৪৫ সিট করা হয়েছে মানুষ ঠিকমতো বসতে পারে না, এ অবস্থায় বাসের ভেতর যাত্রী বান্ধব পরিবেশ কতটুকু রয়েছে— জানতে চাইলে এ পরিবহন নেতা বলেন, ঢাকার চিত্রটা ভিন্ন। তবে সারাদেশে নির্দিষ্ট ভাড়ার চেয়ে কম টাকায় গাড়ি চলে। আর আপনারা যে পত্র-পত্রিকা টেলিভিশনে বলেন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, এটাকে বন্ধ করার বিষয়টা আমরা আগে ভাবছি। উদ্দেশ্য একটাই যাত্রীদের কাছ থেকে সঠিক ভাড়া আদায় করা।

মানহীন এসব বাস নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা কী, জানতে চাইলে তেজগাঁও জোনের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আনোয়ার কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে গাড়ির কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা, নিয়ম মানছে কিনা এসব দেখা। অনিয়ম পেলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। লক্কড়-ঝক্কড় বাসের ফিটনেস কীভাবে হয়, এটা বিআরটিএ বলতে পারবে।

গত ১ ডিসেম্বর থেকে মানহীন বাসের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে বিআরটিএ— জানতে চাইলে বিআরটিএর উপপরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. হেমায়েত উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। এসব বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমাদের লোকবল কম। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি। তবে বাস মালিকদের এ বিষয়ে আরও আন্তরিক হতে হবে।

এমএইচএন/এমজে