গাজীপুরের নয়াপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ভূমি ও গৃহ পেয়ে আবেগাপ্লুত জাহাঙ্গীর আলম। জীবনের ৪৫ বছরে এসে মাথা গোজার ‘ঠাই’ পেয়ে আনন্দের যেন শেষ নেই তার। কারণ এবার অন্যের জমিতে ঘর তৈরি করে থাকা দীর্ঘ সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটবে। ইতোমধ্যে নতুন ঘর নিজের মতো করে সাজানো শুরু করেছেন তিনি।

মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে সারাদেশে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর উপহার দিচ্ছে সরকার। সেই আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর পেয়েছেন কাঠমিস্ত্রি জাহাঙ্গীর। আগামীকাল ২২ মার্চ সেই ঘরের দলিল বুঝিয়ে দিবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জানা যায়, গাজীপুরের শৈলাট এলাকার আব্দুল জব্বারের সন্তান জাহাঙ্গীর। পিতা ছিলেন দিনমজুর। জাহাঙ্গীরের ঘরে রয়েছে স্ত্রী, ২ ছেলে ও ১ মেয়ে। বর্তমানে কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়ে কেমন লাগছে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি কোনদিন ভাবিনি এমন ঘর পাবো। বাবা দিনমজুর ছিলেন। আমি কাঠমিস্ত্রি। অন্যের জমিনে ঘর করে থাকতাম। আল্লাহর রহমতে শেখ হাসিনার উসিলায় আজকে আমি নিজের ‘ঠাই’ পেয়েছি। আধাপাকা ঘরে মাথার উপরে জুটেছে টিন। ভিটে ছিল না বলে অনেকেই আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো, ছোট চোখে দেখতো। এখন বলতে পারব আমার একটু জায়গা আছে, আমিও আধাপাকা ঘরের মালিক।

আগামীকাল বুধবার সকালে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর ঘর হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবন থেকে ভাচুর্য়ালি যুক্ত হয়ে তিন জেলার গৃহহীনদের মাঝে ৩৯ হাজার ৩৬৫টি ঘর উপহার দেবেন তিনি। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে- গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের নওয়াগাঁও ও বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বানারীপাড়া পৌরসভার উত্তরপাড়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শ্রীপুরের গাজীপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের ৮ একর জমির উপরে ১৪২টি ঘর তৈরি করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন, সুপরিসর রাস্তাঘাট ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এ প্রকল্পটি দেখে মনে হবে গ্রামের ভেতর একটি আধুনিক গ্রাম। এছাড়া নয়াপাড়া গ্রামের চারপাশে গড়ে উঠছে বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা। এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী নারী-পুরুষসহ সকল বয়সীদের জন্য থাকছে আত্মকর্মসংস্থানমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। নিজের পায়ে দাঁড়াতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে সব রকম সুযোগ-সুবিধা প্রদানের কার্যক্রম। শিশু কিশোরদের জন্য রয়েছে আলাদা স্কুল।

৮ একর জমির উপরে ১৪২টি ঘর তৈরি করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন, সুপরিসর রাস্তাঘাট ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এ প্রকল্পটি দেখে মনে হবে গ্রামের ভেতর একটি আধুনিক গ্রাম। এছাড়া নয়াপাড়া গ্রামের চারপাশে গড়ে উঠছে বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা

জানা গেছে, গাজীপুর মৌজার সরকারি ১ নম্বর খতিয়ানভুক্ত ৮ একর ১১ শতাংশ জমিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাস্তবায়নাধীন আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর অধীনে ১৪২টি ঘর নির্মিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের দারিদ্র বিমোচনেও বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শতাধিক পরিবারের বসবাসের বিশেষ এ গ্রামে অভ্যন্তরীণ প্রশস্ত রাস্তাসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা, খেলার মাঠ, পুকুর, ফলজ, ভেষজসহ বিভিন্ন গাছের চারা রোপণ, রাস্তার পাশে সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছ রোপণ, পারিবারিক পুষ্টি বাগান, মসজিদ, দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র কাম বিদ্যালয়, রাস্তায় সোলার লাইট স্থাপন, সুপেয় পানির জন্য প্রতি ১০ পরিবারের জন্য সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতেই সরকারের এই উদ্যোগ।

নয়াপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমি ও ঘর পাওয়া খুরশিদ আলম বলেন, ভালুকায় একটি গার্মেন্টসে কাজ করতাম। চার সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থেকেই কাজ করেছি। আগে যা কামাই (আয়) করতাম তা বাসা ভাড়াতেই চলে যেত। সেটা দিয়ে দিন চলে না বলেই এলাকায় এসে রিক্সা চালাই। আগে তো মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হতো, আল্লাহ আমার দিকে তাকিয়েছেন। এখন নিজের জায়গা ও ঘর আছে। ভাড়ার টাকা দিয়ে সংসারের খরচ চালাতে পারব।

একই প্রকল্প থেকে ঘর পেয়েছেন মোছা. হাসনা। তার স্বামী সবুজ মিয়া সিরামিকের মাটি কাটার কাজ করেন। দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে সবাইকে বিয়ে দিয়ে বর্তমানে তারা আলাদা থাকছেন। স্বামীর আয়েই সংসার চলে হাসনার।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার স্বামীর কোনো জায়গা নেই। মানুষের বাড়িতে থাকতাম। শেখ হাসিনার দয়া আমাদের কপালে ঘরটি জুটেছে। ছেলেরা নিজেদের সংসার চলার পর কিছু থাকলে তারপর আমাদের দেয়।

একই ধরনের কথা শুনিয়েছেন এই প্রকল্পের আরেক বাসিন্দা সায়েদ আলী।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া আরেকজন হলেন আব্দুল জলিল। পদ্মার ভাঙনে ঘর-বাড়ি হারিয়ে চলে আসেন ঢাকার তেজগাঁওয়ে। বর্তমানে তিনি থাকছেন মেয়ের জামাইয়ের বাড়িতে। নদী ভাঙনে সব হারানো জলিলও পেয়েছেন গাজীপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর।

তিনি বলেন, মেয়ের জামাইয়ের বাড়িতে থাকি। আর একসঙ্গে থাকতে গেলে অনেক কিছুই হয়। এই ঘর পেয়ে মনে হচ্ছে শান্তিতে বাকি জীবনটা কাটাতে পারবো।

গাজীপুর- ৩ আসনের সংসদ সদস্য ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ বলেন, শ্রীপুরে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। গৃহহীনদের কাউকে বিভিন্ন কলকারখানা কিংবা শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকরি, কাউকে যানবাহন কিনে দিয়ে অথবা কাউকে ছোট দোকান দিয়ে চলার মতো ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রথম পর্যায়ে ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি, মাথার উপর ছাদ পায় ৬৩ হাজার ৯৯৯ গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবার। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০২১ সালের ২০ জুন আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ৫৩ হাজার ৩৩০টি পরিবার ঘর পায়। তৃতীয় পর্যায়ের দুই ধাপে ৫৯ হাজার ১৩৩টি ঘর গৃহহীনদের মাঝে বিতরণ করা হয়। 

এমএসআই/এমজে