দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা পালনের পর এসেছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এ উৎসব ঘিরে প্রতিটি ঘরে ঘরে নানা আয়োজন থাকলেও পর্দার আড়ালেই থেকে যায় কিছু মানুষের সুখ-দুঃখ আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চাপা অনুভূতিগুলো। একই শহরে বসবাস করেও কেউ কেউ বিশেষ এ দিনটিতে একবেলা ভালো খাবার জোগাড় করতে ব্যর্থ হন।

নিয়তির নির্মম পরিহাস এবং বাস্তবতার অমোঘ নীতি যেন ওরা হাসি মুখেই মেনে নিয়েছে। ঈদ হোক বা অন্য কোনো উৎসব; কিছুতেই যেন ওদের আর্তনাদ সমাজ অধিপতিদের ভাবিয়ে তোলে না।

বিলাসবহুল বহুতল ভবন আর কাঁচ ঢাকা গাড়ির জানালা ভেদ করে সমাজের এসব সুবিধা-বঞ্চিতদের আর্তনাদ যেন আমাদের কান অবধি পৌঁছাতে পারে না। সমাজে পিছিয়ে থাকা এসব মানুষকে নিয়ে সবাই ভাবে না; যারা ভাবেন তাদের সংখ্যাও হাতেগোনা। তাদেরই একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন 'ভালো কাজের হোটেল'। এখানে একটি ভালো কাজ করলেই সমাজের পিছিয়ে পড়া সুবিধা-বঞ্চিত এসব মানুষ পাচ্ছেন ভালো মানের খাবার।

সংগঠনটি সমাজের এসব ছিন্নমূল-সুবিধা-বঞ্চিত মানুষের ঈদকে আরও অর্থবহ করে তুলতে নতুন পোশাক এবং ভালো মানের খাবার নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। শুধু ভালো কাজের হোটেল নয়; কয়েকজন পৃথকভাবে খাবারের প্যাকেট নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ঘনিষ্ঠ সম্বোধন আর স্নেহ বঞ্চিত এসব মানুষের কাছে ঈদ মানেই এক প্যাকেট ভালো খাবার। দায়িত্ববোধে মোড়ানো এক প্যাকেট খাবার ঘিরেই যেন ওদের হাসি-কান্নার হিসাব নিকাশ।

শনিবার ( ২২ এপ্রিল) রাজধানীর কমলাপুর, কারওয়ান বাজার এবং বনানী কড়াইল বস্তির পাশে বিশেষায়িত এ হোটেলের তিনটি স্পটেই সুবিধা-বঞ্চিত মানুষের জন্য নতুন পোশাক এবং উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করেছে ভালো কাজের হোটেল। পাশাপাশি খিলগাঁও এবং আশে পাশের এলাকাগুলোতে সুবিধা-বঞ্চিত এসব মানুষের কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিতে দেখা গেছে একদল যুবককে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে ভালো কাজের হোটেল থেকে সুবিধা-বঞ্চিতদের জন্য পোলাও, মুরগির রোস্ট, ডিম এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি সকলের জন্য দেওয়া হয় নতুন পোশাক।
অপরদিকে পৃথকভাবে যারা পাশে দাঁড়িয়েছেন তারাও গরুর মাংস, সাদা ভাত এবং পানি দিয়ে তৈরি করেছেন ঈদ উপহার।

সুবিধা-বঞ্চিত কেরামত আলী ঈদ উপলক্ষ্যে বসেছেন ভালো কাজের হোটেলে। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে তিনি কথা হলে বলেন, ‘আমার বউ বাচ্চা কেউ নাই। রাস্তায় খাই, থাকিও রাস্তায়। কোনো দিন খাবার পাই আবার কখনো না খেয়েই থাকতে হয়। আমাদের খবর আর কে রাখে? এই হোটেল থেকে আমাদের ভালো খাবার দিচ্ছে। ঈদে নতুন কাপড়ও দিছে। বছরে অন্তত দুইবার ভালো খাবার খাইতে পারি। এই হোটেলে প্রায় প্রতিদিনই আমি খেতে আসি। রোজায়ও ইফতার করছি।’

ছবুরন বিবি নামে এক নারী বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। টাকা পয়সা নাই। সব দিন খাবার জুটত না আগে। এখন এই হোটেল থেকে প্রতিদিন খাই। ঈদে আমাকে একটি কাপড় দেওয়া হয়েছে। কাপড় এবং খাবার পেয়ে ভালো লাগছে।’

১০ বছর বয়সী রহমান বলে, ‘ছোটবেলায় মা আমারে রাইখা অন্য জায়গায় চলে গেছে। বাবাকেও পাই নাই। কোন ঈদেই নতুন জামা পরতে পারিনি। এবার ঈদে পাইছি।’

ভালো কাজের হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মো. আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমরা আজকে পাঁচ শতাধিক সুবিধা-বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে তিনটি স্পটে ঈদ উদযাপন করেছি। আমরা ২০১১ সাল থেকেই পরিবারের সঙ্গে ঈদ না করে পথশিশুদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করি। প্রথমদিকে নিজেই প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করতাম। এটাকে একটা অভ্যাসে দাঁড় করাই। এরপর মনে হলো শুধু ভালো কাজ করলেই হবে না সমাজেও ভালো কাজগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে। সেখান থেকেই শুরু। বন্ধুরা মিলে শুরু করলাম। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে সবকিছু।’

এদিকে রাজধানীর খিলগাঁওতে ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়ানো সামছুল আলম সাদ্দাম বলেন, আমি শুধু মানুষের পাশে থাকতে চেয়েছি; এর বেশি কিছু না। ওরা সুবিধা-বঞ্চিত কিন্তু ওরা তো মানুষও। সুখ,দুঃখ, ভালো লাগা বা খারাপ লাগা ওদেরও আছে। আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী এদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি। বুকে টেনে নিতে চেয়েছি। তাদের অভাববোধকে বুঝতে চেয়েছি। আমি বিশাল কিছুই হয়ত করতে পারিনি, অন্তত ৫০টি মানুষের মুখে একবেলা খাবার তুলে দিতে পেরেই খুশি। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে যাক সবার মাঝে। আমাদের মতো ওরাও হাসুক। সুখের হাঁসি-প্রশান্তির
হাঁসি।

এমএম/এসকেডি