প্রবাসীদের ঈদ
অর্থের কাছে তুচ্ছ তাদের আবেগ
বছর পাঁচেক আগে সৌদি আরব যান লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা মো. জামাল উদ্দিন। অর্থের কথা চিন্তা করে এ সময়ে আর দেশে ফেরা হয়নি। দূরদেশে পরিবার ছাড়া একাকী ঈদের দিন অনেকটাই স্বাভাবিক দিনের মতো তার কাছে।
মেসেঞ্জার ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় জামালের। ঈদ উদযাপনের প্রসঙ্গ এলে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলেন, প্রবাসীদের আবার ঈদ! ঈদের দিনও অফিস করলাম। পরিবার পাশে না থাকলে ঈদ আর ঈদ থাকে না। আমাদের আনন্দ বলতে বাংলাদেশিরা দেখা করি, একটু খাওয়া-দাওয়া করি। আর ভিডিও কলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু শান্তি পাওয়া যায়।
বিজ্ঞাপন
বেকারত্বের তকমা মুছতে ধারদেনা করে বছর তিনেক আগে মরিশাস পাড়ি জমান আবদুল বাতেন। পরিবারের খরচ মেটাতে এখনও ঋণের বোঝা টানছেন নোয়াখালীর এ বাসিন্দার। মরিশাসের একটি কনস্ট্রাকশান ফার্মে কাজ করা বাতেন জানান, এখানে শনিবার ঈদ হলো। রোববার এ দেশে ছুটির দিন। কিন্তু আমাদের অফিস খোলা। মনটা ভালো লাগছে না বলে আজ আর কাজে গেলাম না।
বিজ্ঞাপন
ফ্রান্স প্রবাসী মাজু খান ঈদের সময় বাংলাদেশে কাটানো সোনালী দিনগুলোকে হাতড়ে বেড়ান। তার ভাষায়, গত পাঁচ বছরে পরিবারের সঙ্গে ১০টা ঈদ করা হলো না। দেশে থাকতে ঈদে কত কিছুই না কিনতাম। কিন্তু এখন টাকা কামাই কিন্তু খরচ করার ইচ্ছে জাগে না। গ্রামের ছেলেটা কীভাবে দূর প্রবাসে নিশ্চুপ হয়ে গেছে সেই উত্তর খুঁজে পাই না। আগের সেই সোনালী দিন এখন নেই।
আরও পড়ুন : চোখ ভিজে যায়, মন বিষিয়ে ওঠে, তবুও খবর নেয় না স্বজনরা
পরিবারের অর্থের যোগান দিতে কিংবা আরেকটু উন্নত জীবনের আশায় প্রবাসে বসবাস করছেন এক কোটির বেশি বাংলাদেশি। এদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হয়ে গেছেন অনেক বাংলাদেশি। যারা পরিবার ছাড়া বছরের বছর বিদেশে বসবাস করছেন। রেমিট্যান্স যোদ্ধাখ্যাত এসব প্রবাসীদের বছরের পর বছর পরিবার থেকে মাইলকে মাইল দূরত্বে ঈদ করতে হচ্ছে। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে না পারায় মন পোড়ায় তাদের। তাদের ইচ্ছে করে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে। কিন্তু সেই ইচ্ছে বা আবেগ অর্থের কাছে তুচ্ছ।
জার্মানির কটবুস শহরে বসবাস করছেন শিক্ষার্থী আলরাজি। সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন সিলেটের এ বাসিন্দা। আলরাজি গত চার বছরে পরিবারকে ছাড়া ৯টা ঈদ করেছেন। তার ভাষ্য, পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে না পারাটা প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। এখন আর সে রকম লাগে না। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে ভালো সময় কাটে। বন্ধুরা সবাই মিলে ঘুরতে যাই, খাওয়া-দাওয়া করি, আড্ডা দেই; এভাবে দিন চলে যায়। দেশের ঈদ খুব মিস করি। দেশের স্মৃতিগুলো সত্যিই অসাধারণ।
লন্ডনে বসবাসরত শিক্ষার্থী আফরোজা আলীম তার অনুভূতির কথা প্রকাশ করতে গিয়ে বাবার মৃত্যুর খবরে দেশে ফিরতে না পারা নিয়ে আক্ষেপ করেন। তিনি বলেন, ছয় মাস হলো পড়তে লন্ডনে এলাম। এর মধ্যে বাবা মারা গেল, যেতে পারিনি। এ দুঃখ হয়ত কখনও ভোলার নয়। পরিবার ছাড়া ঈদটা এই প্রথম বাইরে করলাম।
বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদেরও পরিবার ছাড়া ঈদ করতে হচ্ছে। ঈদের দিন এসব শিক্ষার্থীরা বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়ে হয়ত দিনটি পার করে দেন। কিন্তু পরিবার ছাড়া তাদের ঈদের রঙ যে ফিকে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
জোনায়েদুল ইসলাম স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ইতালিতে বসবাস করছেন। ইতালির মিলানে বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে ঈদের দিনটা ভালো উদযাপন হলেও বাবা-মাসহ অন্য ভাই-বোনদের খুব মিস করেন জোনায়েদ।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চাকরি জীবনের অনেকটা সময় বিদেশের মাটিতে পার করতে হয় কূটনীতিকদের। পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সব কোনেই বিচরণ করতে হয়। বছরের পর বছর পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে না পারার কষ্ট নিজের মধ্যে লালন করতে হয় তাদের।
আরও পড়ুন : দায়িত্বের কাছে হার মেনেছে আবেগ
ইসলামাবাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনে দায়িত্ব পালন করা এক কূটনীতিক বলেন, পুরো পরিবার সঙ্গে না থাকলে ঈদের আনন্দ পরিপূর্ণ হয় না। দায়িত্ব পালন করতে বিদেশে বিদেশে থাকতে হবে, এটা-তো আমাদের জন্য অনিবার্য। সঙ্গে স্বামী-সন্তানরা আছে। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যরা-তো নেই। মাকে খুব মিস করি ঈদের দিন।
জেনেভায় বাংলাদেশ মিশনে কাজ করা কূটনীতিক শাহীন মোহাম্মদ বলেন, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঈদ করলাম। কিন্তু বাংলাদেশে যে ঈদের আনন্দ সেটা-তো এখানে নেই। পরিবারের অন্য সদস্যরা না থাকলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে ঈদ।
এনআই/এসকেডি