রেশাদ আকবর প্রত্যয় / ছবি: সংগৃহীত

২০০৩ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন রেশাদ আকবর প্রত্যয়। এইচএসসিতেও পান জিপিএ-৫। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে অনার্স শেষ না করে ২০০৯ সালে চলে যান রাশিয়ায়। সেখানে জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চার বছর মেয়াদী অনার্স করেন। এরপর পিএইচডি শুরু করেন। করোনাকালে দেশে ফিরে আসেন তিনি।

কিন্তু বাংলাদেশে এসে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছিলেন না প্রত্যয়। এ নিয়ে বেশ হতাশায় ভুগছিলেন তিনি। প্রেম করে বিয়ে করার দুই বছরের মাথায় আর্থিক অনটনের জেরে ভেঙে যায় তার সংসারও।

গত ২৯ এপ্রিল রাজধানীর পল্লবী থানার মিরপুর-১২ নম্বরের সি ব্লকের ২ নম্বর সড়কের একটি ভাড়া বাসা থেকে প্রত্যয়ের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, ৩৬ বছর বয়সী প্রত্যয় সর্বশেষ একটি বায়িং হাউজে চাকরি করতেন। নিজেই ধারালো বটি দিয়ে গলা কেটে আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা পুলিশের। তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একটি চিরকুট। যেখানে ‘আত্মহত্যার’ ইঙ্গিতপূর্ণ কথা লিখেছেন তিনি।

পরিবারও বলছে হতাশা ছিল প্রত্যয়ের। নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যাশিত চাকরি পাচ্ছিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে বায়িং হাউজে চাকরি নিয়েছেন। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আরও ভেঙে পড়েন প্রত্যয়। এসব হতাশা থেকে আত্মহত্যা করতে পারেন তিনি।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে প্রত্যয়

পল্লবী থানা পুলিশ, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বাসার অন্য রুমমেটদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই বাসায় মোট ছয়জন থাকতেন। ঘটনার দিন বাসায় ছিলেন পাঁচজন।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সকাল ৭টা ৮ মিনিটের দিকে একজন বাসা থেকে বের হন। এরপর সকাল ৭টা ৩৩ মিনিটের দিকে আরেকজন বের হন। ঘটনার সময় বাসায় ছিলেন মোট তিনজন। তারা হলেন- প্রত্যয়, পাশের রুমের সুমন ইসলাম ও আসাদ শেখ। সুমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, আসাদ পেশায় ড্রাইভার।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সুমন ও আসাদ জানান, ঘটনা সম্পর্কে আগে থেকে কিছু আন্দাজ করতে পারেননি তারা। তারা দুজনই ঘুমাচ্ছিলেন। গোঙানির শব্দ শুনে রুমের বাইরে এসে দেখেন বেসিনের নিচে প্রত্যয় রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। এরপর বাসার মালিক এসে দরজা খোলেন। পরে ঘটনাস্থলে আসে পল্লবী থানা পুলিশ।

ঘটনার সময় বাসায় অবস্থান করা সুমন ইসলাম বলেন, আমি ঘুমাচ্ছিলাম। গোঙানির শব্দ শুনে উঠি। রুমের বাইরে গিয়ে দেখি প্রত্যয় রক্তাক্ত পড়ে আছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাসা থেকে বের হওয়া দুই রুমমেটকে ফোন করে জানাই। একজন জানান প্রত্যয়কে ব্রাশ করতে দেখে গেছেন।

সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে দেখা যায় রক্তাক্ত প্রত্যয়কে

পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বাসার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছি। সিসি ক্যামেরায় দরজা খোলার অংশ দেখা যায়, ভেতরে বেসিনের একটা অংশও বোঝা যাচ্ছিল। আটটা ৩৫ মিনিটের দিকে বাড়ির মালিককে দরজা খুলতে দেখা যায়। দরজা খুলে তিনি প্রত্যয়কে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেন। সিসি ক্যামেরায় দেখা যায় বেসিনের নিচে পড়ে ছিল প্রত্যয়ের নিথর দেহ। পাশে ছিল ধারালো বটি।

তিনি বলেন, আমরা বাসার সব বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। বিশেষ কোনো তথ্য পাইনি। তারা বলেছে, প্রত্যয় কথা কম বলতেন। তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাত। মাত্র তিনমাস আগে ওই বাসায় ওঠা প্রত্যয় অন্যদের সঙ্গে খুব কম মিশতেন।

অপমৃত্যুর মামলা

প্রত্যয়ের মরদেহ উদ্ধারের পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি ও সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের কার্যক্রম শেষে ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পল্লবী থানা পুলিশ। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন নিহতের বড় ভাই আসিফ আকবর খান নিপ্পন। তিনি সব শুনে পল্লবী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেন। সেদিন রাতে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবার প্রত্যয়ের মরদেহ গ্রামে নিয়ে যায়।

উদ্ধার হওয়া চিরকুট ও বাবার সঙ্গের ফোনালাপে ‘আত্মহত্যা’র সন্দেহ

পল্লবী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) পারভেজ ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। নিহত প্রত্যয়ের বাবা জানিয়েছেন ঘটনার আগের দিন রাতে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তখন প্রত্যয় মুঠোফোনে বলেছিলেন, ‘বাবা আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না, পারলে ক্ষমা করে দিও।’ পরদিন সকালেই এই ঘটনা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মরদেহ উদ্ধারের পর ওই বাসায় তল্লাশি করে আমরা একটি চিরকুট পাই, যেখানে লেখা ছিল, ‘আমি এই মহাবিশ্বের একমাত্র গ্রহ যাতে প্রাণ আছে, সেটাকেই ধ্বংস করে ফেললাম। হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা কর’।

বাবার সঙ্গে প্রত্যয়

ওসি পারভেজের দাবি— ‘ডাইনিংয়ে আয়না দেখে বটি দিয়ে প্রত্যয় গলা কেটে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। তার লেখা চিরকুট, ফোনে বাবার সঙ্গে কথোপকথন আর সিসিটিভির ফুটেজ দেখে প্রাথমিকভাবে আমরা এমনটি ধারণা করছি।

তিনি বলেন, আমরা হত্যার কোনো আলামত পাইনি। একই বাসার অন্য বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদেও হত্যার মতো কোনো তথ্য পাইনি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

‘চিরকুটের’ লেখা প্রত্যয়ের কি না পরীক্ষা করবে পুলিশ

ওসি পারভেজ ইসলাম বলেন, আমরা পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। নিহত প্রত্যয়ের বড় ভাই নিপ্পন দেখে জানিয়েছেন, চিরকুটে লেখা প্রত্যয়ের হাতের লেখায় মিল রয়েছে। এরপরও আমরা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় শতভাগ নিশ্চিত হতে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের হস্তবিশারদের কাছে পাঠাব।

যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি না পাওয়ায় হতাশ ছিলেন প্রত্যয়

ছোট ভাইয়ের এমন মৃত্যু মানতে পারছেন না আসিফ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যয় অত্যন্ত মেধাবী। ও এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। অনার্স শেষ না করেই ২০০৯ সালে স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য রাশিয়ায় যায়। সেখানে জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চার বছর মেয়াদি কোর্স করে। এরপর ও সেখানে পিএইচডি করছিল। লাস্ট পেপারটা বাকি থাকতেই প্রত্যয় দেশে ফেরে।

দেশে ফেরার পর বিয়ে করে। এর মধ্যেই করোনা চলে আসে। ওর যোগ্যতা অনুযায়ী দেশে চাকরি মিলছিল না। টুকটাক বিষয় নিয়ে পারিবারিক কলহ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগের এক সহপাঠীর সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রেমের পর বিয়ে করেছিল প্রত্যয়। দুই বছরের মধ্যে তা বিচ্ছেদে রূপ নেয়। যোগ্যতা অনুযায়ী দেশে চাকরি না পাওয়াটা মানতে পারেনি প্রত্যয়।

প্রত্যয়কে কেক খাইয়ে দিচ্ছেন বড়ভাই আসিফ

আসিফ বলেন, প্রত্যয় মানসিক অবসাদের কারণে যশোরের উত্তরা ক্লিনিকে চিকিৎসক জিল্লুল কামালের অধীনে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রায় হতাশার কথা জানাত। ঘটনার আগের রাতেও বাবাকে ফোন করে ক্ষমা চেয়েছে সে।

তিনি বলেন, আত্মহত্যা কি না তা তদন্তে স্পষ্ট হবে। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, চিরকুট, বাবাকে ফোনে বলা কথা ও সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী পুলিশ আত্মহত্যা বলছে। আমার ভাইয়ের মৃত্যুটা অনাকাঙ্ক্ষিত। আত্মহত্যা হলে বলব, উচ্চ শিক্ষা, যোগ্যতা, মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়া ওর আত্মঘাতী হওয়ার বড় কারণ। সে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পেলে বৈবাহিক বিচ্ছেদও হয়তো ঘটত না, এমন মৃত্যুও হয়তো দেখতে হতো না।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, হতাশা ও মানসিক অবসাদে ভোগা রোগীদের পক্ষে আত্মহত্যা সম্ভব। সেটা যেকোনো উপায়েই সম্ভব। বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতার মধ্যে দেখা যায় সাধারণত গলায় ফাঁস, বিষ পান ও মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন। এছাড়া ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে, ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে কিংবা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার কথা শোনা যায়।

তিনি বলেন, গলা কেটে নিজেকে হত্যা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। বাংলাদেশে এর নজির আছে। গলার পুরো অংশ কাটার প্রয়োজন পড়ে না। যদি গলার স্পর্শকাতর অংশে সামান্যও কাটা পড়ে তবে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। প্রত্যয়ের ঘটনা আদৌ আত্মহত্যা নাকি হত্যা তা তদন্ত সাপেক্ষে জানা যাবে। আমি এতটুকু বলব, মানসিক অবসাদে ভোগা রোগীদের দ্বারা এমন আত্মহত্যার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়।

জেইউ/কেএ