মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইজারাদার ক্যাসিনো আলী বাবাকে খুঁজছে দুদক
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের ইজারাদার ও পরিচালক ক্যাসিনো আলী বাবা নামে খ্যাত আলী আহমেদকে খুঁজছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জুয়া, ক্যাসিনো ব্যবসা ও চোরাই কাপড়ের ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে দুদক। অনৈতিক ব্যবসা ও সম্পদের নথিপত্র পেতে এনবিআর, ভূমি, সাব-রেজিস্ট্রেশন, সরকারি- বেসরকারি ব্যাংকসহ অর্ধশত প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
বিজ্ঞাপন
তবে খাতা-কলমে লাপাত্তা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের এক সময়ের নিয়ন্ত্রক আলী আহমেদকে এখনও খুঁজে পায়নি দুদকের অনুসন্ধান টিম। শিগগিরই তাকে তলব করে চিঠি দিতে পারে সংস্থাটি। আসতে পারে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা। যদিও ধারণা করা হচ্ছে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে তিনি দেশত্যাগ করেছেন।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের বিষয়ে দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্যাসিনোকাণ্ডে ইতোমধ্যে ২৩টির মতো মামলা দায়ের করা হয়েছে। একইভাবে ১০টি মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এসব মামলায় সম্পৃক্ত অবৈধ সম্পদও জব্দ করা হয়েছে। বেশ কিছু আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কাউকে কাউকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে আইনের নিখুঁত প্রয়োগ করা হয়েছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি, ছাড় দেওয়া হবে না।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক পরিচালক ও ক্যাসিনোবিরোধী দুর্নীতি সংক্রান্ত অনুসন্ধান টিমের প্রধান সৈয়দ ইকবাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের টিম এ বিষয়ে অনুসন্ধান কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। যেহেতু অনুসন্ধান চলমান রয়েছে, তাই বক্তব্য দেওয়ার সময় আসেনি।
আলী আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র চালাত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। সংসদের কমিটি না থাকায় সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তা আপদকালীন দায়িত্ব পালন করেছেন। গুলিস্তানের স্থাপনার ভাড়ার টাকার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ছিল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের। ক্লাব ভবন নির্মাণের কিছুদিন পরই জায়গাটি ভাড়া দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কয়েক বছর আগে আলী আহমেদ এটি ভাড়া নিয়ে জুয়া-ক্যাসিনো শুরু করেন। অনৈতিকভাবে ক্লাবটির ইজারা নেন কথিত আওয়ামী লীগ নেতা এই আলী আহমেদ। ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। দৈনিক ভাড়া ছিল দেড় লাখ টাকা, মাসে ৩৫ লাখ। অবশ্য ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর প্রায় ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বাকি রেখেই গা ঢাকা দেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শুরুতে ক্লাবটির ইজারা নেওয়া ইজারাদার হারুনুর রশিদ মারা যান ২০১৪ সালে। এরপর উঁকি দেন হকার থেকে আওয়ামী লীগ নেতা বনে যাওয়া আলী আহমেদ। মৃত হারুনের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে হোসনে আরা বিউটি নামে এক নারীর নামে ক্লাবের ইজারা করিয়ে নেন আলী আহমেদ। বিউটি আসলে মৃত হারুনের স্ত্রী নয়। হারুনের স্ত্রী রুবিনা খাতুন। থাকতেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কাগজপত্র জালিয়াতি করে, হারুনের স্ত্রী হিসেবে দেখানো হয় বিউটিকে। পরে তাকে বিয়েও করেন আলী আহমেদ। এভাবে আলী আহমেদ ক্লাবটি নিজের কব্জায় নিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, অন্তত চার বছর আগে ক্যাসিনো শুরু করেন আলী আহমেদ। সে সময় তিনি কাগজে-কলমে ক্লাব পরিচালনার কোনো দায়িত্বে ছিলেন না। এরপর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি সম্রাটের সহযোগিতায় ২০১৪ সালে ক্লাবটির দখল নেন তিনি। এরপর শুরু করেন ক্যাসিনো কারবার। ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে আলী আহমেদ লাপাত্তা।
ক্যাসিনোকাণ্ডে ইতোমধ্যে ২৩টির মতো মামলা দায়ের করা হয়েছে। একইভাবে ১০টি মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এসব মামলায় সম্পৃক্ত অবৈধ সম্পদও জব্দ করা হয়েছে।
দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাব ও আলী আহমেদকে ঘিরে আরও অভিযোগ রয়েছে অবৈধভাবে তাকে ক্লাবের জায়গা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ক্লাবের ভেতরে দোকান, ক্যান্টিন নির্মাণের জন্য ১ কোটি টাকা বিনিয়োগের চুক্তি হয় আলী আহমেদের সঙ্গে। চুক্তি অনুযায়ী, এই টাকা ক্রীড়াচক্রের অ্যাকাউন্টে অগ্রিম জমা দেওয়ার কথা, যা পরে ক্রমান্বয়ে খরচ করতে পারবেন আলী আহমেদ। উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে এই টাকা ভাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করা যাবে। তবে দুই বছরে দোকান ও ক্যান্টিন নির্মাণের জন্য কোনো টাকা ব্যয় করেননি আলী আহমেদ। বরং ক্লাবের জায়গা দখল করতে সাবেক ঠিকাদার হারুনের স্ত্রী সাজিয়ে বিউটিকে সামনে রাখেন আলী আহমেদ ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় সম্রাট, আলী আহমেদসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন হারুনের স্ত্রী রুবিনা খাতুন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের ইজারাদার আলী আহমেদ লোক চক্ষুর আড়ালে একবার দেশেও ফিরেছিলেন। সে সময় কৌশলে আবারও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র কব্জায় নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি বলে দুদকের গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। প্রায় তিন মাস ক্যাসিনোবিরোধী মোট ৪৯টি অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৩২টি অভিযান র্যাব এবং ১৭টি অভিযান পুলিশ পরিচালনা করে। এসব অভিযানে ২৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে ঢাকায় গ্রেফতার হন ২২২ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫৩ জন।
ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত ক্লাবগুলো হলো—রাজধানীর মতিঝিলে মোহামেডান ক্লাব, ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র, কলাবাগান ক্রীড়াচক্র, ধানমণ্ডি ক্লাব, ফু-ওয়াং ক্লাব, বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ, চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব ও আবহানী ক্লাব। এরপর আরও বেশ কয়েকটি ক্যাসিনোতে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাসিনোর মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। কমিশনের পরিচালক সৈয়দ ইকবালের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি টিম অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব পালন করছেন। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. সালাহউদ্দিন, গুলশান আনোয়ার প্রধান, সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, আতাউর রহমান ও মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী।
আরএম/এনএফ