• সারাদিন বৃষ্টি ছিল কক্সবাজার-টেকনাফে
  • সাগর থেকে সাম্পান সরিয়েছিল জেলেরা
  • মোখার সর্বোচ্চ গতি ছিল ১৪৭ কিলোমিটার
  • লন্ডভন্ড হয়েছে সেন্টমার্টিন
  • উড়ে গেছে বিভিন্ন ঘরের চাল
  • মেরিন ড্রাইভে ভেঙ্গে পড়েছে বহু গাছ
  • আশ্রয়কেন্দ্রে না খেয়ে ছিল শিশু-বৃদ্ধরা

ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ বাংলাদেশের কক্সবাজার-টেকনাফ উপকূল অতিক্রম করে মিয়ানমারের দিকে গেছে রোববার (১৪ মে) সন্ধ্যার কিছু আগে। তার আগে বিকেল ৩টার দিকে কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়টি। তবে মোখার প্রভাবে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি ছিল কক্সবাজার-টেকনাফে। ঘণ্টায় ১৪৭ কিলোমিটার বেগের এই অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে বাংলাদেশের একমাত্র বদ্বীপ সেন্টমার্টিনকে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকে কক্সবাজার এলাকায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে থাকে। যার ফলে কক্সবাজার এলাকার মানুষের জীবনে একরকম স্থবিরতা নেমে আসে। বেলা ১১টা পর্যন্তও খুব প্রয়োজন ছাড়া কাউকে তেমন ঘর থেকে বের হতে দেখা যায়নি। শহরে হাতেগোনা কয়েকটি খাবারের দোকান ছাড়া তেমন কোনো দোকান খোলা দেখা যায়নি। সড়কে যানবাহনের সংখ্যাও ছিল কম। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বিক্ষুব্ধ থাকলেও দেখা গেছে বেশ কিছু পর্যটক সৈকতে এসেছেন মোখার প্রভাবে অশান্ত সমুদ্র দেখতে। সময় যত বাড়তে থাকে বৃষ্টির পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে কক্সবাজারে। স্থানীয়রা জানান, শনিবার (১৩ মে) গভীর রাত থেকেই বৃষ্টি শুরু হয় এখানে। এছাড়া আবাসিক হোটেলগুলোতে অতিথির সংখ্যা কম রয়েছে বলে জানা গেছে।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে টেকনাফ যাওয়ার পথে বৃষ্টি ও বাতাসের পরিমাণ আরও বাড়তে দেখা যায়। দুপুর ১টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া এলাকার মেরিন ড্রাইভ সড়কে দেখা যায়, ‘সাম্পান’ সরিয়ে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন জেলেরা। ৮/১০ জন সাম্পানগুলো সরানোর কাজ করছিলেন। সরিয়ে নিতে সাম্পানের নিচে চাকা লাগিয়ে সেটিকে ৪ চাকার গাড়ির মতো তৈরি করা হয়। সাম্পানকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টেনে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় ট্রাক্টর।

সাম্পান সরাতে কাজ করা সেলিম নামে একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বাহারছড়া গ্রামের জেলে। এখানে আমাদের অনেকগুলো সাম্পান রয়েছে। বাতাস ও ঢেউ আমাদের সাম্পানগুলো ভেঙে ফেলে। ঘূর্ণিঝড়ে যেন সাম্পান ভেঙে না যায় সেজন্য সরিয়ে নিচ্ছি। উপায় নেই, ঝোড়ো বাতাসের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে সরাতে হচ্ছে।

টেকনাফ পৌঁছার কাছাকাছি সময়ে বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যায় বহুগুণে। টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের পাশে যখন ঢাকা পোস্ট টিমের গাড়ি, তখন বাতাসের চাপে টিমের গাড়ি আর সামনে এগোনো যায়নি। সেসময় গাড়িতে বসে দেখা যায়, বাতাসের চাপে মেরিন ড্রাইভের পাশে থাকা সারি সারি ঝাউ গাছ দুলতে থাকে। এর মধ্যে কয়েকটি গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে। মেরিন ড্রাইভের অন্য পাশে থাকা বাড়িঘরগুলোর টিনের চাল উড়ে যায়। ভেঙ্গে যায় বাড়ির সীমানা প্রাচীরও। বাড়ির লোকজন শেল্টার হাউজে থাকায় কেউ আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এভাবেই চলতে থাকে প্রায় তিন ঘণ্টা।

বিকেল ৫টার পর বাতাসের গতিবেগ কমতে থাকে। তারপর ঢাকা পোস্ট টিম টেকনাফের কয়েকটি জনপদ ও দুটি শেল্টার সেন্টার ঘুরে দেখে।

জনপদগুলো ঘুরে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সড়কের পাশের গাছগুলো ভেঙ্গে রাস্তায় পড়ে গেছে। অনেক মানুষের বাড়িঘর ভেঙ্গে মাটিতে মিশে গেছে। পড়ে আছে শুধু কিছু টিন আর কাঠ। স্থানীয় একটি গবাদিপশুর বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া পুরো এলাকা দেখে মনে হয়েছে, যেন বিধ্বস্ত এক নগরী।

টেকনাফ মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে সাইক্লোন পারপাস প্রোগ্রামের আওতায় কাজ করা প্রাথমিক চিকিৎসক মোহাম্মদ ইসহাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, টেকনাফের ৫নং ওয়ার্ড এলাকা এটি। এটার আশ্রয় কেন্দ্র হচ্ছে টেকনাফ পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় ও টেকনাফ প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত তিন দিন ধরে আমরা কাজ করছি। এখানে যারা আশ্রয়ের জন্য এসেছে তারা সবাই মেহনতি মানুষ। আজ সকালে তারা এখানে এসেছে। কিন্তু সকাল থেকে তাদের পানি ছাড়া কিছু খাওয়াতে পারিনি। ফেসবুকে পোস্ট করার ৫ ঘণ্টা পর একজন ব্যক্তি তাদের জন্য কলা ও রুটি পাঠিয়েছেন। এই কলা-রুটি তাদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছি।

এখানে বর্তমানে ১৩০ জনের মতো নারী, পুরুষ ও শিশু আছে। পাশের গ্রামগুলো থেকে এখনো লোকজন আসছে, অনেকের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। তারা রাতে এখানে থাকবেন কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু পাননি। তারা বারবার আমাদের কাছে খাবার চাইছেন কিন্তু আমরা দিতে পারছি না।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির হাজাম পাড়া মাল্টি পারপাস সেন্টারের শেল্টারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রায় ২৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সেন্টারের টেকনিক্যাল প্রজেক্ট অফিসার মাহমুদ মুন্না ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মাল্টি পারপাস সেন্টারে আমাদের কাজের পাশাপাশি দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে এটি ব্যবহার করি। আমাদের এখানে আশ্রয় নেওয়াদের আমরা শুকনো খাবার দিয়েছি।

ওই শেল্টার আশ্রয় নেওয়া হোসনে আরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেনেছি আমার ঘর ভেঙ্গে গেছে। আমার স্বামী মারা গেছে। তিন সন্তানসহ পরিবারে আমরা চার জন। চিন্তা করছি, এখন কীভাবে সেই ঘর ঠিক করব। এখানে আমরা দুপুরে চিড়া আর গুড় খেয়েছি।

টেকনাফ থেকে কক্সবাজারে ফেরার পথে রাত ৮টার দিকে দেখা যায়, মেরিন ড্রাইভ রোডে অসংখ্য গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে গেছে। যে কয়েকটি গাছ রাস্তার মাঝে পড়েছিল সেগুলো কেটে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।

এদিকে, তীব্র বাতাস ও ঝোড়ো হাওয়ায় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ৫০০টির মতো ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলো মেরামতে শেল্টার সেক্টর ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান বলেন, মোখার তাণ্ডব সন্ধ্যার পর শিথিল হয়ে গেছে। সতর্ক সংকেট কমে এলে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা আড়াই লাখ মানুষ ঘরে ফিরতে পারবেন। সেন্টমার্টিনে ১ হাজর ২০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও ১১ জন আহত হয়েছেন। জেলায় ১০ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

/এমএইচএন/এসএসএইচ/