খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে বাড়ি নির্মাণের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

একদিকে সর্বোচ্চ আদালতের অনুসন্ধানের সময়সীমার বিষয়ে নির্দেশনা, অন্যদিকে অনুসন্ধানের স্বার্থে চাহিদাকৃত নথিপত্র না পাওয়ায় কাজে গতি আসছে না। বিশেষ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে চাহিদাকৃত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পাওয়া নিয়ে জটিলতায় দুদকের অনুসন্ধান টিম।

নথিপত্র তলবের প্রায় দুই মাস অতিক্রম করা হলেও দিচ্ছি-দেবো বলে এখনো চাহিদাকৃত নথিপত্র সরবরাহ করা হয়নি সংস্থাটিকে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রথম দফায় গত ২৮ মার্চ চিঠি দেয় দুদক। এরপর ৩, ৯ ও ১৩ এপ্রিল তিন দফায় তাগিদপত্রও দেওয়া হয়। এমনকি অনুসন্ধান টিমের এক কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ের গিয়েও নথি সরবরাহের তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু এখনো নথিপত্র সরবরাহ করা হয়নি বলে মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন : সুমনের রিট : সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রুল

সবশেষ গত ৭ মে পঞ্চমবারের মতো ৮ ধরনের নথিপত্র চেয়ে তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কেন সরবরাহ করা হচ্ছে না এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও উপসচিব অভিজিত রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য না পাওয়ার কারণে দেরি হচ্ছে। সেখানের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেলেই আমরা পাঠিয়ে দেবো।

অন্যদিকে এ বিষয়ে অনুসন্ধান টিম প্রধান ও দুদক উপপরিচালক ইয়াছির আরাফাতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি জনসংযোগ দপ্তরের যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন।

জনসংযোগ দপ্তরে যোগাযোগ করে হলেও সেখান থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক সময়সীমা নির্ধারিত হওয়ায় দ্রুত সময়ে চাহিদাকৃত নথিপত্র না পাওয়ায় দুদকের কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। এর আগেও চার দফায় মৌখিক ও লিখিতভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে চাহিদাকৃত অধিকাংশ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র এখনো পাওয়া যায়নি।

যেসব নথিপত্র তলব করা হয়েছে
১. গুলশান আবাসিক এলাকার অবিভক্ত পরিত্যক্ত প্লট নং-২৭ সিই এন(ডি) রোড নং-১০৪, গুলশান-২, ঢাকা সংক্রান্ত মূলনথি।

২. গুলশান আবাসিক এলাকার অবিভক্ত প্লট নং-২৭ সিইএন (ডি) হোল্ডিং নং ২৯, রোড নং-১০৪, যা বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬ এর মাধ্যমে ‘খ’ তালিকার ৪৬ নং সিরিয়ালে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই প্লটটি কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় গেজেটভুক্ত হয়েছে তার বিস্তারিত প্রতিবেদন।

৩. প্লটটি অবমুক্ত করা হয়েছিল কী না? যদি হয়ে থাকে অবমুক্তির প্রক্রিয়াসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন।

৪. প্লট রাজউক কর্তৃক বরাদ্দ দিতে পারে কী না? অথবা বরাদ্দ দিয়ে থাকলে এ বিষয়ে রাজউকের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের পত্র যোগাযোগসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন।

৫. গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের শাখা-১২ এর স্মারক নং-৯/১পি-গুল-১০০/৭৬/২৮ তারিখ: ১৮/২/১৯৯৬ মূলে দেওয়া চিঠি কী ভিত্তিতে পাঠানো হয়েছে এবং চিঠি প্রেরণকারী কর্মকর্তা সাবেক সহকারী সচিব আবদুস সোবহানের বর্তমান কর্মস্থল ও যোগাযোগের ঠিকানা।

আরও পড়ুন : সালাম মুর্শেদীর সরকারি সম্পত্তি দখল, রাজউকের ১৩ কর্মকর্তাকে তলব 

৬. গুলশান আবাসিক এলাকার প্লট নং-২৭ সিইএন (ডি) বর্তমান বাড়ি নং-২৭/বি, রোড নং-১০৪, গুলশান- ২, ঢাকা সংক্রান্ত মূল নথিটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ডে হস্তান্তর করা হয়নি, ওই নথির বর্তমান অবস্থান এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কোন কোন কর্মকর্তা ১৯৮৬ সাল থেকে হালনাগাদ পর্যন্ত নথির কাস্টডিয়ান তাদের নামের তালিকা, পদবি ও যোগাযোগের ঠিকানা।

৭. প্লটটি বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সংখ্যা ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬ এর মাধ্যমে ‘খ’ তালিকাভুক্ত করা হয়। গেজেটভুক্ত হওয়ার পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত ওই প্লটের সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনয়নে মন্ত্রণালয় হতে কী কী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে তার বিস্তারিত প্রতিবেদন।

৮. ১০ম জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি কর্তৃক গঠিত বিশেষ নিরীক্ষা দল কর্তৃক দাখিলকৃত অডিট প্রতিবেদন ২০০৬-০৮ এর জবাব পর্যালোচনায় দেখা যায় ‘গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গুলশান আবাসিক এলাকার প্লট নং সিইএন (ডি) ২৭ বাড়িটি পরিত্যক্ত তালিকা থেকে অবমুক্ত না করে গৃহীত কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মে অডিট আপত্তিটি প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করা হয়’। ওই অডিট প্রতিবেদনের বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় যদি কোনো তদন্ত করে থাকে, সে প্রতিবেদন।

এদিকে সালাম মুর্শেদী বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানে রাজউকের ১৩ কর্মকর্তাকে তলব করেছে দুদক। তাদের আগামী ১৮, ২১ ও ২২ মে দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। তলব করা ব্যক্তিরা হলেন, রাজউকের সাবেক আইন উপদেষ্টা ড. মো. সেলিম, সহকারী আইন উপদেষ্টা মো. মনসুর হাবিব, সাবেক সদস্য (এস্টেট) অব, কর্নেল নুরুল হক, রাজউকের পরিদর্শক (এস্টেট) শাহ মো. সদরুল আলম, সহকারী টাউন প্ল্যানার মাহফুজুল কাদের, ডেপুটি টাউন প্ল্যানার কাজী গোলাম হাফিজ, উপ-পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) অমিত কুমার দেবনাথ ও টাউন প্ল্যানার জাকির হোসেন, রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-১) হাবিবুর রহমান ও মো. নুরুল ইসলাম এবং সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. খোরশেদ আলম ও ভূইয়া রফিউদ্দিন।

আরও পড়ুন :  সালাম মুর্শেদীর বাড়ি : প্রকৃত তথ্য জানাবেন অ্যাটর্নি জেনারেল

নথি জালিয়াতির মাধ্যমে সালাম মুর্শেদীকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন গুলশান-২-এর ১০৪ নম্বর সড়কে সিইএন (ডি)-২৭ নম্বর বাড়িটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এমন অভিযোগ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ২০২২ সালের ১১ আগস্ট দুদকে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। দুদক আবেদন আমলে না নেওয়ায় একই বছরের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন তিনি।

রিট আবেদনে বলা হয়, রাজধানীর গুলশান-২-এর ১০৪ নম্বর সড়কের ২৭/বি নম্বর বাড়িটি ১৯৮৬ সালের অতিরিক্ত গেজেটে ‘খ’ তালিকায় পরিত্যক্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত। কিন্তু আব্দুস সালাম মুর্শেদী সেটি দখল করে বসবাস করছেন। রিটে ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল, ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি ও চলতি বছরের ৪ জুলাই রাজউক চেয়ারম্যানকে দেওয়া গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তিনটি চিঠি যুক্ত করা হয়। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দেওয়া চিঠিতে পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকা থেকে বাড়িটি অবমুক্ত না হওয়ার পরও আব্দুস সালাম মুর্শেদী কীভাবে বাড়িটি দখল করে আছেন, রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে এ ব্যাখ্যা চেয়েছিল গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। কিন্তু রাজউক চেয়ারম্যান সে চিঠি আমলে না নেওয়ায় ৪ জুলাই আবারও চিঠি দেওয়া হয়।

ওই চিঠিতে বলা হয়, পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকা থেকে ভবনটি অবমুক্ত না হওয়ার পরও কীভাবে রাজউক চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে সেটির নামজারি ও দলিল করার অনুমতি দেওয়া হলো, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু রাজউক চেয়ারম্যান সে ব্যাখ্যা দিতে অনিহা দেখিয়েছেন। রিটের শুনানিতে হাইকোর্টের আদেশে ১০ দিনের মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান এবং আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে হলফনামা আকারে নথি দাখিল করতে বলা হয়। একই সঙ্গে রুলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির ‘খ’ তালিকাভুক্ত বাড়িটি বেআইনিভাবে দখল করার অভিযোগে আব্দুস সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান, দুদক চেয়ারম্যান, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে রুলের জবাব দিতে বলে হাইকোর্ট। এর পরপরই দুদক অভিযোগটি আমলে নেয়।

মন্ত্রণালয়ের তদন্তে মিলেছে অভিযোগের সত্যতা
দুদকের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অধিশাখা-৯ এর যুগ্মসচিব মাহমুদুর রহমান হাবিবকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য সচিব রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) মুহাম্মদ কামরুজ্জামান এবং সদস্য হিসেবে ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং শাখা-১১ এর উপসচিব জহুরা খাতুন।

ওই তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সরেজমিন পরিদর্শন ও গুলশান আবাসিক এলাকার লে-আউট নকশা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রোড নং ১০৪ ও রোড নং ১০৩-এর সংযোগস্থলের কর্নারের প্লট/বাড়িটি (২৭ নং প্লট) অবস্থান বিবেচনায় ১০৪ নং রাস্তায় অবস্থিত। যা ১৯৮৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত ৯৭৬৪ (১) নং পৃষ্ঠার ৪৬ নং ক্রমিকে ‘খ’ তালিকাভুক্ত পরিত্যক্ত বাড়ি। অর্থাৎ ঢাকার গুলশান আবাসিক এলাকার গুলশান সিইএন (ডি) ব্লকের ১০৪ নং রোডের ২৯ নং হোল্ডিংয়ের ২৭ নং বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি। সর্বশেষ জরিপ/সিটি জরিপে সংশ্লিষ্ট এলাকার সিইএন (ডি) ব্লকের ২৭ নং প্লটের ৫২০৪ ও ৫২০৫ দাগসমূহ সিটি জরিপের ৯ নং খতিয়ানভুক্ত, যা সরকারের পক্ষে গণপূর্ত নগর উন্নয়ন বিভাগ ঢাকার নামে রেকর্ডভুক্ত। বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির ‘ক’ ও ‘খ’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি এবং অবমুক্তির কোনো অবকাশ নেই।

তদন্ত কমিটি বলছে, বাস্তবে ওই এলাকায় রাজউকের লে-আউট নকশায় কথিত বাড়ির অস্তিত্ব বিদ্যমান নেই। এ ক্ষেত্রে সুকৌশলে ওই এলাকার ১০৪ নং রোডে অবস্থিত ওই বাড়িটি ১০৩ নং রোড দেখিয়ে জাল-কাগজপত্র সৃজনপূর্বক হস্তান্তর-নামজারিসহ অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদীর সঙ্গে ফোনে ও ক্ষুদে বার্তায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

আরএম/এসএম