রাজধানীর কারওয়ানবাজার কাঁচা বাজার (মূলত আড়ত) মার্কেটটিকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আগে মার্কেটটি বন্ধ করতে তৎপরতা দেখাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনও (ডিএনসিসি)। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। আটকে আছে ঢাকার অন্যসব ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ভাঙার কাজও।

অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট বা ভবন ভাঙা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গত ১১ মে কারওয়ানবাজার কাঁচা বাজার (আড়ত) মার্কেটে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। অভিযানে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে অভিযান অসমাপ্ত রেখে চলে আসতে হয় সংশ্লিষ্টদের। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত সেখানে দোকান উচ্ছেদ বা মার্কেট ভাঙার কাজের কোনো অগ্রগতি নেই।

১১ মে’র অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বীর আহমেদ।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযানটির লক্ষ্য ছিল মার্কেটটির দোকানগুলোর বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করা। সেখানে বর্তমানে ১৭৬টি দোকান রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় গত এপ্রিলে নোটিশ দিয়ে মার্কেটটি ছাড়তে বলা হয়েছিল ব্যবসায়ীদের। কিন্তু তারা সেটি না মানায় অভিযানে গিয়েছিলাম। অভিযানকালে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত সময় এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে। এখন যেকোনো দিন ডিএনসিসির পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করে মার্কেটটি সিলগালা করে দেওয়া হবে।

শুধু কারওয়ানবাজার কাঁচা বাজার মার্কেটই নয় বুয়েটের ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ ভবনের তালিকায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ২০টি মার্কেট ও বিপণি-বিতান রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের আওতায় ১১টি এবং ঢাকা উত্তরের আওতায় ৯টি অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ও বিপণি বিতান রয়েছে। এসব মার্কেটে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও ঝুঁকি উপেক্ষা করেই চলছে এসব মার্কেটে বেচাকেনা। প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রেতার সমাগম ঘটছে। তালিকা অনুযায়ী অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট বিবেচনা করে কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনও নেয়নি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন।

সিটি কর্পোরেশনের দাবি, তাদের উদ্যোগ ঠিক ছিল বা আছে। ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে তা এখনো কার্যকর করা যায়নি। তবে শিগগিরই তারা এ কাজ শুরু করবে।

ডিএনসিসির অতিঝুঁকিপূর্ণ ৯ মার্কেট

বুয়েটের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মোট ৯টি মার্কেট অতি ঝুঁকিপূর্ণ।  এগুলো হলো- কারওয়ান বাজার কাঁচামালের আড়ত মার্কেট, কারওয়ান বাজার ১ নম্বর ভবন মার্কেট, কারওয়ান বাজার ২ নম্বর ভবন মার্কেট, গুলশান উত্তর কাঁচাবাজারের হলুদ মার্কেট, গুলশান দক্ষিণ পাকা মার্কেট, মোহাম্মদপুর টাউন হল পাকা মার্কেট, মোহাম্মদপুর কাঁচা বাজার এবং মোহাম্মদপুর রায়ের বাজার মার্কেট।

এসব মার্কেটে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রতীকী লাল সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে মার্কেটগুলো এখনো বন্ধ করা যায়নি। জীবনের মূল্য ভুলে গিয়ে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকির মধ্যেই বেচাকেনা করছেন।

ডিএসসিসির ঝুঁকিপূর্ণ ১১ মার্কেট

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ১১টি অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট আছে। যার মধ্যে বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটও ছিল। এগুলো সম্প্রতি আগুনে পুড়েছে। এই দুটি ছাড়া বাকি ৯টি মার্কেটের মধ্যে রয়েছে- আজিমপুর কবরস্থান মার্কেট, আজিমপুর এতিমখানা মার্কেট, দেবীদাস ঘাট সংলগ্ন বরিশাল হোটেল ভবন, জিন্দাবাহার প্রথম লেনের ভবন, দয়াগঞ্জ ট্রাকস্ট্যান্ড রোড সাইড ভবন, নয়াবাজার নওয়াব ইউসুফ মার্কেট কমপ্লেক্স, ঠাটারিবাজার মার্কেট, খিলগাঁও রেলওয়ে কাঁচাবাজার এবং সিদ্ধেশ্বরীতে লিলি প্লাজা মার্কেট। এসব মার্কেটে ঝুঁকি উপেক্ষা করে চলছে বেচা কেনা।

আরও আছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দুই দফায় রাজধানীর বিভিন্ন ভবন পরিদর্শন করে ২ হাজার ৫২৮টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব জরিপে দেখা গেছে, ডিএসসিসির ১০টি অঞ্চলের মধ্যে ৫টি অঞ্চল পরিদর্শন করে তারা ৪৬টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, প্রতিটি মার্কেটকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়ার আমরা সেগুলো পর্যায়ক্রমে নিচ্ছি। কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের কাজ আমরা শুরু করেছি। ব্যবসায়ীরা আমাদের সহযোগিতা করলে এ কাজটি করা আরও সহজ হবে। পাশাপাশি ক্রেতাদের অনুরোধ করব আপনারা ঝুঁকিপূর্ণ এসব মার্কেটে কেনাকাটা করতে যাবেন না। তাহলে ব্যবসায়ীরা এসব ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ছেড়ে যাবেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, মার্কেটগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করতে সম্মিলিত দীর্ঘ মেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। রাজধানীর মার্কেটগুলোতে নিয়মিত তদারকি করবে ডিএসসিসির গঠিত কমিটি। কিছু মার্কেট বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে ভেঙে ফেলা হবে।

এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটে শুধু নোটিশ দিয়েই দায় এড়াতে চায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। যেকোনো সময় এসব মার্কেটে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সিটি কর্পোরেশনের উচিত দ্রুত এসব মার্কেট সিলগালা করে ব্যবসায়ীদের অন্য কোথাও পুনর্বাসন করা।

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতা ও উদাসীনতা আছে, যার দায় দোকান মালিক সমিতি ও ব্যবসায়ী নেতারা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। এ অবস্থার লাগাম টানা না গেলে আগামী দিনগুলোতে নগর এলাকার মার্কেট, বিপণি-বিতান কিংবা বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডসহ নানান দুর্ঘটনা আরও বাড়তে থাকবে।

এএসএস/এসকেডি