ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা ১টা ছুঁইছুঁই। উত্তপ্ত সূর্য মাথার ওপর থেকে তাপ ছড়াচ্ছে। কড়া রোদ, তীব্র গরম, যানজট, উচ্চ শব্দের হর্ন সব মিলিয়ে বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতি। এর মধ্যেই রাজধানীর নতুন বাজার এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক সার্জেন্ট মানবেন্দ্র রায়। প্রচণ্ড গরমে তার পোশাক ভিজে একাকার। বারবার মুখের ঘাম মুছে সড়কের এক পাশের গাড়ি ছেড়ে অন্য পাশ ধরে রাখছেন। ছায়া বলতে হাতের ছাতাই একমাত্র ভরসা।

শুধু মানবেন্দ্র রায়ই নন, তার মতো একই অবস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের। তীব্র গরমের কারণে সাধারণ মানুষ যখন বাইরে বের হতে ভয় পায় তখন কড়া রোদে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের। অনেক সময় প্রচণ্ড পিপাসা পেলেও রাস্তায় গাড়ির চাপ বেশি থাকলে ট্রাফিক বক্সে গিয়ে পানি পান করার সুযোগ পান না তারা।

রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের অনেকে ১০ বছর আবার কেউ বা ৫-৬ বছর ধরে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এবারের মতো তাপদাহ এর আগে কখনো দেখেননি তারা। এমনিতেই রাজধানীতে প্রচণ্ড গাড়ির চাপ সামলাতে তাদের নানা রকম সমস্যা হয়। এছাড়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে অতিরিক্ত শব্দ দূষণ থেকে শুরু করে বায়ু দূষণের শিকার হতে হয় তাদের। এ কারণে প্রতিনিয়ত নানা শারীরিক সমস্যা পোহাতে হয়। এর মধ্যে চলমান তাপদাহ তাদের কষ্টের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে শত কষ্টে হলেও দায়িত্ব পালন করতে পিছু হটেছেন না ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।

মঙ্গলবার (৬ জুন) দুপুরে রাজধানীর বেশ কয়েকটি সড়কে সরেজমিনে ঘুরে ও রাস্তায় দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, গত কয়েকদিনের মতো মঙ্গলবারও রাজধানীতে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। প্রচণ্ড এ তাপপ্রবাহে বাতাসেও অনুভূত হচ্ছে গরম। একদিকে রাস্তায় গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা, অন্যদিকে গাড়ির হর্ন ও সাইরেনের শব্দে কঠিন পরিস্থিতি। প্রতিকূল পরিবেশে অনড় অবস্থায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের।

যেসব রাস্তার পয়েন্ট ট্রাফিক বক্স আছে, সেখানকার দায়িত্বরতরা কিছুক্ষণ পরপর ভেতরে গিয়ে জিরিয়ে নেন। আর যেসব রাস্তায় ট্রাফিক বক্স নেই সেখানকার দায়িত্বরতরা সেই সুযোগটুকু পান না।

এ বিষয়ে রাজধানীর নতুন বাজার এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট মানবেন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোদ, বৃষ্টি কিংবা গরম সব পরিস্থিতিতেই আমাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। দায়িত্বে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিদিন রাজধানীতে লাখ লাখ মানুষ যানবাহনে চলাচল করে। এই চলাচল নির্বিঘ্নে রাখতে আমাদের অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই। তবে একটা কথা বলতে হয়, গত ৬ বছর ধরে আমি ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু এবারের মতো তাপদাহ আগেও কোনো দেখিনি। গরমের কারণে এবার রাস্তায় কাজ করতে আমাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। বার বার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার পরেও অর্পিত দায়িত্ব অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য কোরবান মিয়া বলেন, প্রচণ্ড গরম ও শব্দ দূষণের মধ্যেই দায়িত্ব পালন করতে হয়।  ডিউটি শেষ করে বাসায় যাওয়ার পরে শরীর অস্থির লাগে। এর মধ্যে দায়িত্ব পালনের সময় অনেক গাড়ি চালক নানাভাবে আমাদের কটু কথা বলেন, তখন অনেক খারাপ লাগে। এই গরমের মধ্যে রোদে দাঁড়িয়ে যাদের জন্য দায়িত্ব পালন করি তারা যখন কটু কথা বলে তখন অনেক খারাপ লাগে। এসব কটু কথা প্রায় প্রতি-দিনই শুনতে হয়।

তবে প্রচণ্ড এই তাপদাহে শুধু ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নয় রাস্তায় যাতায়াত করা সকল মানুষকে এ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষদের ভোগান্তি দেখে নিজেদের ভোগান্তি আর কষ্টকে কিছুও মনে হয় না ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ৩ নম্বর গেটের সামনে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট রাব্বী বলেন, আসলে নন-এসি বাস দিয়ে যেসব যাত্রীরা গাদাগাদি করে এ গরমের মধ্যে যাতায়াত করেন তাদের কথা চিন্তা করলে আমাদের কষ্টটা আর কষ্ট মনে হয় না। আসলে মানুষ যেন এই গরমের মধ্যে দ্রুত নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে কোনো ধরনের ভোগান্তি ছাড়া সেই জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তারা

তীব্র এই গরমে দায়িত্ব পালনরত বেশ কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তীব্র দাবদাহে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ট্রাফিক সদস্যই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সর্দি-জ্বর, ডিহাইড্রেশনসহ নানা শারীরিক সমস্যা হচ্ছে তাদের।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, চলমান এ গরমে অনেক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ট্রাফিক সদস্যরা সব থেকে বেশি ডিহাইড্রেশনজনিত সমস্যায় ভুগছেন।

তিনি আরও বলেন, যেসব ট্রাফিক সদস্যের হাই-প্রেশার আছে তাদের এই গরমে দায়িত্ব পালন করতে আরও বেশি সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া ইউনিফর্ম পরে এ গরমে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আরও বেশি সমস্যা হচ্ছে। আবার যেসব পুলিশ বক্স টিন-শেডের সেখানে আরও ভয়াবহ গরম। ফলে সেখানে বিশ্রাম নেওয়ারও সুযোগ নেই।

আছে বাথরুম ও বিশুদ্ধ পানির সংকট

তীব্র এই গরমে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের আরও কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। এর মধ্যে সব থেকে বড় সমস্যাটি হচ্ছে বাথরুম। ট্রাফিক বক্সে সাধারণত বাথরুম থাকে না। এই গরমের মধ্যে হাতমুখ ধোয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের।

এ বিষয়ে মো. রফিক নামে এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বলেন, বাথরুমের সমস্যা আমাদের অনেক আগে থেকেই। বক্সে কোনো বাথরুম থাকে না। ফলে দায়িত্বরত এলাকার আশপাশের কোনো শপিং মল কিংবা বাসা বাড়ির বাথরুম ব্যবহার করতে হয়। তাই গরমের মধ্যে হাত, মুখ ও পা ধুয়ে একটু ফ্রেশ হওয়ারও ব্যবস্থা নেই। আর মানুষের বাসা বাড়ি কিংবা শপিং মলে দায়িত্ব ছেড়ে তো বার বার যাওয়া যায় না। এছাড়া অনেক সময় এমন এলাকার রাস্তায় দায়িত্ব পড়ে যেখানে বিশুদ্ধ পানির অভাব থাকে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে এই গরমে অনেক সদস্য ডিহাইড্রেশনজনিত সমস্যায় ভুগছেন।

প্রচুর পরিমাণ পানি ও  স্যালাইন পানের পরামর্শ 

গরমে ট্রাফিক সদস্যরা যেন নিজেদের সুস্থ রাখতে পারেন সে জন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তীব্র এই তাপদাহে নিজেদের সুস্থ রাখতে মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক কর্মকর্তাদের বেশি বেশি স্যালাইন ও পানি পান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের যুগ্ম কমিশনার এসএম মেহেদী হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই গরমে শুধু ট্রাফিক সদস্যরা নয়, সবাই কষ্ট করছেন। যারা রাস্তায় বের হচ্ছেন তারাই কষ্ট করছেন। তবে মানুষের যেন ভোগান্তি না হয় সে জন্য ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কাজ করে যেতে হবে এবং তারা কাজ করে যাচ্ছেন। এই গরমের মধ্যে তারা যেন নিজেদের ফিট রাখতে পারেন এবং অসুস্থ না হয়ে পড়েন সে জন্য মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক সদস্যদের বেশি বেশি স্যালাইন ও পানি পান করতে বলা হয়েছে।

১১ জুনের আগে তাপদাহ থেকে রক্ষা নেই

দেশের ৬০টি জেলার উপর দিয়ে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। সাত বিভাগের সবকটি জেলা এই তাপপ্রবাহের আওতায় রয়েছে। আগামী ১১ জুনের আগে এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।

এমএসি/এসকেডি