রাজধানীর গুলশান-২ এর একটি শপিং মলে নিজের গাড়িতে করে কেনাকাটা করতে এসেছেন বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। সঙ্গে আছেন তার স্ত্রী ও দুই সন্তান। কিন্তু সেই শপিং মলের পার্কিংয়ে গাড়ি রাখার স্লট ফাঁকা না থাকায় গাড়ি নিয়ে আশপাশে ঘুরছেন পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজতে। কিন্তু কোথাও তিনি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। এছাড়া কিছু দিন আগে রাস্তার পাশে গাড়ি রাখার কারণে মামলাও খেয়েছেন তিনি। যে কারণে গাড়ি পার্কিংয়ে এবার সচেতন তিনি। কিন্তু কোথাও পার্কিং করার স্থান না পেয়ে পড়েছেন বিড়ম্বনায়।

রাজধানীতে বসবাসরত ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকদের পার্কিং নিয়ে এমন সমস্যা পোহাতে হয় প্রতিদিনই। যাদের গাড়ি আছে তারা গাড়িসহ বাইরে বের হলেই নিরাপদ পার্কিং নিয়ে সমস্যার কারণে ত্যক্ত-বিরক্ত। তাই এবার এমন সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)।

যত্রতত্র পার্কিং দূর করতে ঘণ্টাপ্রতি টাকা পরিশোধ করে অ্যাপের মাধ্যমে সড়কের পাশে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে ডিএনসিসি। আর এই অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ির মালিক বা চালক দেখতে পাবেন আশপাশে কোথায় পার্কিং স্লট ফাঁকা আছে। পরে সেখানে গিয়ে অ্যাপ ব্যবহার করে যে কেউ তাদের গাড়ি পার্কিং করতে পারবেন। অন স্ট্রিট পার্কিংয়ের নাম দেওয়া হয়েছে ডিএনসিসি স্মার্ট পার্কিং।

ঘণ্টাপ্রতি ফি নির্ধারণ করে অ্যাপভিত্তিক পার্কিংয়ের ব্যবস্থায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে গুলশানের কয়েকটি সড়কে পার্কিংয়ের স্থানও নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এখনও তা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ফাইনাল অনুমোদন পায়নি ডিএনসিসি। অনুমোদনের অপেক্ষায় আটকে আছে ডিএনসিসির স্মার্ট পার্কিং উদ্যোগটি।

এর আগে ডিএনসিসির পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চেয়ে চিঠি পাঠায় সংস্থাটি। পরে তারা যাচাই-বাছাই করে ফি নির্ধারণের বিষয়সহ আরও বেশ কিছু তথ্য জানতে চেয়ে ডিএনসিসির কাছে চিঠি পাঠায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পরে এসব উত্তর দিয়ে ডিএনসিসিও ফের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়।

জানা গেছে, এই উদ্যোগটি চালু করতে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর ঘণ্টাপ্রতি স্মার্ট পার্কিংয়ের ফি অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালায়ে চিঠি পাঠায় তারা। পরে গত ১২ জানুয়ারি পার্কিং নীতি, সংশোধিত রেট চার্ট জমা দিতে বলা হয় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এরপর ২৬ জানুয়ারি ফের ডিএনসিসির পক্ষ থেকে এর উত্তর পাঠানো হয়। গত ২ এপ্রিল মন্ত্রণালয় থেকে পার্কিং ব্যবস্থার ফি, বোর্ড সভায় অনুমোদন হয়েছে কী না এবং আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এসব যাচাই-বাছাই শেষে খুব শিগগিরই চালু হবে ডিএনসিসির স্মার্ট পার্কিং ব্যবস্থা।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি  কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা বলেন, স্মার্ট পার্কিং বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে আরও কিছু তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এদিকে আমাদেরও প্রায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি। আশা করা যাচ্ছে খুব শিগগিরই আমরা এই স্মার্ট সেবাটি চালু করতে পারব।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে গুলশান এলাকায় ২০২টি গাড়ি স্মার্ট পার্কিংয়ের মাধ্যমে পার্কিং করতে পারবে। প্রথমে গুলশান এলাকায় এই সেবা চালু করা হলেও পরবর্তীতে ডিএনসিসির আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত করা হবে সেবাটি।

প্রথমে গুলশানের ৪৬, ৫২, ৫৮, ৬২, ৬৩, ৬৪ ও ১০৩ সড়ক, গুলশান-২ এর কাঁচাবাজারের আশপাশের সড়কে এই স্মার্ট পার্কিং সেবাটি প্রাথমিকভাবে চালু হতে যাচ্ছে। অ্যাপ ব্যবহার করে যে কেউ এসব নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে গাড়ি পার্কিং করতে পারবে। এছাড়া অ্যাপ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট জায়গায় পার্কিংয়ের জন্য আগাম বুকিং করে রাখাও যাবে।

গাড়ি পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে প্রথম ২ ঘণ্টার জন্য ফি পড়বে ৫০ টাকা, পরের ঘণ্টা অর্থাৎ ৩য় ঘণ্টায় ফি যুক্ত হবে আরও ৫০ টাকা। এরপরের ঘণ্টার জন্য প্রতি ঘণ্টায় পার্কিং ব্যবহারকারীকে গুনতে হবে ১০০ টাকা করে। এছাড়া মোটরসাইকেল পার্কিং করার ক্ষেত্রে প্রথম দুই ঘণ্টার জন্য ১৫ টাকা, ৩য় ঘণ্টা থেকে ১৫ টাকা এবং ৩য় ঘণ্টার পর থেকে প্রতি ঘণ্টার জন্য ৩০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

স্মার্ট পার্কিং সেবার বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, যানজট নিরসনে ডিএনসিসি এই স্মার্ট পার্কিং প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সকল কিছু প্রস্তুত করে এটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদন হয়ে এলেই আমরা এই স্মার্ট পার্কিং সেবাটি চালু করতে পারব। প্রথমে নির্দিষ্ট এলাকায় এটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে সফল হলে উত্তর সিটির আওতাধীন অন্যান্য এলাকাতেও এই স্মার্ট পার্কিং ব্যবস্থা চালু করা হবে।

জানা গেছে, স্মার্ট পার্কিংয়ের জন্য ব্যবহৃত ডিএনসিসির স্মার্ট পার্কিং অ্যাপে প্রথমে নিবন্ধন করে এই পার্কিং সেবা নিতে পারবেন গাড়ির মালিক ও চালকরা। এছাড়া অ্যাপটির মাধ্যমে দেখতে পারবেন নিজের লোকশনের আশপাশে কোথায় কোথায় পার্কিং লট ফাঁকা আছে। পাশাপাশি বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও গাড়িটি যেখানে যাবে তার আশপাশে নির্দিষ্ট বা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পার্কিং করার জন্য বুকিং দিয়ে রাখা যাবে অ্যাপটির মাধ্যমে।

পার্কিংয়ে যেন বেশি সংখ্যক মানুষ সুবিধা পায় সেজন্য প্রথম দুই ঘণ্টা পার্কিং ফি নির্দিষ্ট রাখা হলেও এর পরের ঘণ্টা থেকে ফি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে বেশি সময় একটি গাড়ি পার্কিংয়ে রাখতে নিরুৎসাহিত হয় মালিক ও চালকরা। প্রথম দিকে স্মার্ট পার্কিং সেবার ফি ক্যাশ পেমেন্ট নেওয়া হবে না। এটি পরিশোধ করতে হবে অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং এবং ব্যাংক কার্ড দিয়ে। এছাড়া পার্কিং স্থানে পয়েন্ট অফ সেলস (পিওএস) মেশিনের মাধ্যমে পার্কিং স্পটে পার্কিং ফি পরিশোধ করা যাবে। তবে যাদের এসব সুবিধার জন্য ব্যাংক কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নেই তাদেরকে পার্কিং কার্ড দেওয়া হবে। আর সেখান থেকেই পার্কিং চার্জ কেটে নেবে কর্তৃপক্ষ।

নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা হলে দ্বিগুণ জরিমানা আদায় করা হবে। এই স্মার্ট পার্কিং ব্যবস্থা বাস্তবায়নে ডিএনসিসি, ডিএমপি ও এলওসিসি যৌথভাবে কাজ করবে। এছাড়া পার্কিং পয়েন্টের বাইরে আশপাশে কেউ গাড়ি পার্কিং করছে কিনা তা দেখতে গুলশান এলাকায় ৮ জন নিরাপত্তা কর্মী নিয়োজিত রাখবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।

গুলশানের রাস্তায় স্মার্ট পার্কিংয়ের পয়েন্টের কাজ চলাকালীন ডিএনসিসির এই স্মার্ট পার্কিংয়ের উদ্যোগ সম্পর্কে জেনেছেন নিকেতনের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। স্মার্ট পার্কিং ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, যাদের গাড়ি আছে তারা রাজধানীর কোথাও বের হলে প্রথমেই দুশ্চিন্তা করেন কোথায় পার্কিং করব। কমবেশি হলে ট্র্যাফিক পুলিশ মামলা দিবে। এমন নানান টেনশন কাজ করে। তাই যাদের গাড়ি আছে তাদের জন্য পার্কিং ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিএনসিসির রাস্তায় কাজ করার সময় জানতে পারলাম তাদের এই স্মার্ট পার্কিং সম্পর্কে। এমন অ্যাপভিত্তিক স্মার্ট পার্কিং ব্যবস্থা আসলেই খুব ভালো লেগেছে।

তিনি আরও বলেন, আমি বা আমার পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই গুলশানে কেনাকাটার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হই। কিন্তু সেক্ষেত্রে পার্কিং করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায় না। অনেক সময় ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে যায়, পরে আমরা ডাকলে আবার আমাদের নিতে আসে। এখন যদি অ্যাপভিত্তিক এই স্মার্ট পার্কিং বা অনস্ট্রিট পার্কিং ব্যবস্থা চালু হয় তাহলে গাড়ির মালিকরা বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাবে। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশে এ সেবা আছে। এখন আমাদের দেশে এটি চালু হলে নিশ্চিন্তে গাড়ি নিয়ে বের হতে পারবে সবাই।

এমজেইউ