হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের অকেজো কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় করতে হবে
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুশাসন নিশ্চিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার অকেজো কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি যা আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
‘হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, অবাক করা বিষয়, হাসপাতালে জনবল কাঠামোর কোনো দালিলিক তথ্য নেই, অর্গানোগ্রাম নাই। পরিচালনায় প্রয়োজনীয় নীতিমালার অনুপস্থিত। সংশ্লিষ্ট আইন প্রতিপালন ও তার কার্যকর প্রয়োগ ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, হাসপাতালের লাইসেন্স নিয়মিত নবায়ন না করা, ক্রয় আইন, তথ্য অধিকার আইন ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল সংক্রান্ত আইন ও বিধান অমান্য করলেও সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়নি। হাসপাতালের জন্য পৃথক জনবল কাঠামো না থাকায় অপরিকল্পিত নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিসহ হাসপাতালের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে জবাবদিহিতা নেই। একটি মানবিক সহায়তা সংস্থা এবং রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের অংশ হলেও হাসপাতালটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার কর্তৃক অনুদান এবং আয় ও ব্যয়ের হিসাব সঠিকভাবে নথিভুক্ত করেনি। এর ফলে অংশীজনদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
প্রতিষ্ঠানটি আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন স্ব-প্রণোদিতভাবে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়নি। ফলে হাসপাতাল কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনার সাথে সাথে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, সুবিধা ও সেবার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতেও ব্যর্থ হয়েছে। অদক্ষ কর্মীদের নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি প্রদান করায় অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।
অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অসম চুক্তিসহ বিবিধ দুর্নীতির কারণে চিকিৎসা সেবার মান নিম্নগামী হয়েছে। ফলে সুনাম নষ্ট হয়েছে এবং রোগীর পরিমাণ ও হাসপাতালের আয় হ্রাস পেয়েছে। অন্য হাসপাতালের সাথে প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয়ে ক্রমেই একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
ড. ইফতেখার বলেন, হাসপাতালটিতে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতির পরিপন্থি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে যা প্রতিষ্ঠান দুটির সুনাম বিনষ্ট করছে। এর দায় প্রতিষ্ঠান দুটি কোনোভাবে এড়াতে পারে না।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে হাসপাতাল পরিচালনার ক্ষমতায় বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে উল্লেখ করে ড. ইফতেখার বলেন, চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও হস্তক্ষেপে প্রতিষ্ঠানটিতে জবাবদিহি নিশ্চিতে বাধা সৃষ্টি করেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য অবশ্যই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। সুশাসনের যে মৌলিক বিধিমালা রয়েছে সেগুলো সংযোজন করে পুরো কার্যক্রমে প্রয়োগ করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি যা আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত হবে।
সুপারিশ
গবেষণার ফলাফলের আলোকে সুশাসনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ উত্তরণে বেশ কিছু সুপারিশ প্রস্তাব করেছে টিআইবি।
>> বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি অর্ডার, ১৯৭৩ বা প্রেসিডেন্টস অর্ডার নং ২৬, ১৯৭৩ সংশোধন করে চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা হ্রাস করতে হবে। আয়-ব্যয় ও কার্যক্রম ও নীতি-সিদ্ধান্ত বোর্ড সভার সর্বসম্মত ভিত্তিতে গৃহীত হতে হবে। বোর্ডের নিকট জবাবদিহি সাপেক্ষে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়িত হতে হবে।
>> হাসপাতালের জন্য একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত মানবসম্পদ বা অর্গানোগ্রাম তৈরি।
>> পৃথক বিধিমালার প্রণয়ন করে হাসপাতালে নিয়োগ ও দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধা নির্দিষ্ট করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
>> হাসপাতালের সুনাম পুনরুদ্ধার ও সেবার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং অবকাঠামো সংস্কার ও মেরামতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
>> প্রয়োজনীয়তা যাচাই সাপেক্ষে কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
>> হাসপাতালে আয়-ব্যয় ও ক্রয়সহ সকল কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। একটি বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা তৈরি এবং সব ধরনের ক্রয় নিয়ম মেনে সম্পাদন করতে হবে।
>> হাসপাতালের বিভিন্ন তথ্য স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশ সম্পর্কে তথ্য অধিকার আইনের সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী প্রকাশ করতে হবে।
>> চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনভিত্তিক বার্ষিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
>> সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য দায়ীদেরকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত করে কার্যকর জবাবদিহিতা ও শাস্তি নিশ্চিতে ব্যবস্থা করতে হবে।
>> হাসপাতাল পরিচালনা ও তদারকিতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংশ্লিষ্টদের বাদ দিয়ে একটি স্বাধীন হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করতে হবে।
>> সেবাগ্রহীতা কর্তৃক অভিযোগ দাখিলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং অভিযোগ নিরসন করে সেবার মান উন্নয়ন করতে হবে।
>> হাসপাতালের সকল ধরনের ক্রয়ে সংশ্লিষ্ট আদেশ ও নিয়ম-নীতি কঠোরভাবে পালন করতে হবে।
>> হাসপাতালের সকল ধরনের নিয়োগ ও পদোন্নতি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পক্ষপাতহীন ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হতে হবে।
>> কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিক আচরণ বিধি প্রবর্তন করতে হবে। এটি তাদের মধ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
>> হাসপাতালের আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব নিশ্চিতে সকল ধরনের নথিপত্র সংরক্ষণ ও নিয়মিতভাবে বাৎসরিক ভিত্তিতে খ্যাতিসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক স্বাধীনভাবে নিরীক্ষা করতে হবে।
>> প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়সহ প্রশাসনিক সকল কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনতে হবে।
>> হাসপাতালের ওয়েবসাইটে প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সেবা সম্পর্কিত তথ্যের নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে।
>> হাসপাতালের সকল সেবা, সেবা মূল্য, সেবা প্রদানের সময়সূচি উল্লেখপূর্বক একটি পরিপূর্ণ নাগরিক সনদ ও তথ্যবোর্ড হাসপাতালের প্রধান ফটকে প্রদর্শন করতে হবে। বিভাগ অনুযায়ী কর্তব্যরত চিকিৎসকের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন ও প্রদর্শন করতে হবে।
>> হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে জনগণকে জানাতে এবং উৎসাহিত করতে প্রচার বাড়ানোর সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, টিআইবির পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মুহাম্মদ বদিউজ্জামান, পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন কনসালটেন্ট তাসলিমা আক্তার ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (গবেষণা ও পলিসি গবেষণা) মো. মাহ্ফুজুল হক।
জেইউ/ওএফ