একজন টানছেন হাপর, ওই হাপরের সৃষ্ট বাতাসে কয়লায় গনগন করে উঠছে আগুন। আগুনে পোড়া লাল লোহায় পড়ছে হাতুড়ির আঘাত। সজোরে ভেসে আসছে টুংটাং শব্দ। আগুনে লাল হওয়া লোহাকে আকৃতি দিতে তৈরি হচ্ছে ছুরি, চাপাতি, দা, বটিসহ নানান সব উপকরণ। হাতুড়ি পিটিয়ে এসবকে আকৃতি দিচ্ছেন কামার শিল্পী। পাশেই একজন শান দিয়ে এসবকে চকচকে করে তুলছেন।

পবিত্র কোরবানির ঈদ যতই এগিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে এসব কামার শিল্পীদের ব্যস্ততা। হাপর টানার সঙ্গে সঙ্গে আগুন ঘন হচ্ছে, উৎপন্ন হচ্ছে তীব্র গরমের। আগুন গরমে ঘেমে জবুথুবু কারিগররা। তবুও নেই বিশ্রাম, বলতে গেলে এখন তাদের দম ফেলারও সময় নেই।

সারাবছর অলস সময় পার করলেও প্রতি বছর কোরবানির ঈদের আগে ব্যস্ততা বেড়ে যায় এসব কামার শিল্পীদের। নাওয়া, খাওয়া, বিশ্রাম বাদ দিয়ে দিনরাত চলে আগুন-লোহার কাজ। কারণ ঈদের আগেই কাস্টমারকে দিতে হবে সেসবের ডেলিভারি। দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো রাজধানীর কামার শিল্পীদেরও এসময়ে বেড়েছে ব্যস্ততা। রাজধানীর কারওয়ানবাজার, খিলগাঁও, ভাটারা, ধোলাইখালসহ বেশ কিছু এলাকাতে রয়েছে কামারপট্টি। এসব পট্টিতে দিনরাত এক করে চলছে কাজ। ক্রেতাদেরও সমাগম হচ্ছে বেশ। তারা এসে কেউ তৈরি করতে দিচ্ছেন ছুরি, চাপাতি, কেউবা পুরাতনগুলো ঠিক করে নিচ্ছেন। এছাড়া তৈরি করা ছুরি, চাপাতি, বটিও থরে থরে করে সাজানো আছে দোকানগুলোতে। সব মিলিয়ে কোরবানির ঈদে পশু জবাই করা, মাংস কাটার সব উপকরণের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। সেইসঙ্গে লোহা, কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার এসব উপকরণের দামও বেড়েছে।

রাজধানীর ভাটারা এলাকায় পূর্বপুরুষের কামার শিল্পের ব্যবসা ধরে রেখেছেন কমল সরকার। তিনিও তার দোকানে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আগুনে লাল লোহা দিয়ে একটি চাপাতি বানিয়েছেন মাত্র। তার পাশেই বসা অলক সরকার সেই চাপাতিতে শান দিয়ে চকচকে করে তুলছেন।

ব্যবসার সার্বিক বিষয় নিয়ে কমল সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছরের অন্য সময় একবারে ফাঁকা থাকলেও প্রতি বছর কোরবানির ঈদের আগে বেচা-বিক্রি বেড়ে যায়। এখন যেহেতু ঈদের দুই/তিন দিন বাকি, সেহেতু এখন প্রচুর কাজের চাপ। দিনরাত কাজ করে যেতে হচ্ছে তাদের। তবে আগের তুলনায় কাজ কমেছে। কারণ বাজারে বিভিন্ন দোকানে ঈদের সময় রেডিমেড, চাইনিজ সব চাপাতি, চাকু, ছুরি পাওয়া যায়। সেগুলো দেখতেও সুন্দর, তাই অনেকে এখন ওগুলো কেনেন। তবে আমরা যেগুলো লোহা পিটিয়ে বানাই সেগুলোর মান এবং স্থায়িত্ব অনেক বেশি, গুনগত মানের হয়।

তিনি বলেন, এখন সব কিছুর খরচ অনেক বেশি। আগের মতো এখন আর লাভ করা যায় না। কারণ এগুলো ভালো মতো কাজ করতে হলে লাগে রেলের লোহা, এখন এসব লোহা ১৩০/১৪০ টাকা কেজি পড়ে যায়। এক বস্তা পাথর কয়লা ২৫০০-২৬০০ টাকা বস্তা পড়ছে। যা আগে অনেক কম ছিল। ফলে এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে গেছে। এছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে একদম ফাঁকা বসে থাকতে হয়, অনেকে ব্যবসাও ছেড়ে যাচ্ছেন। আমার বাবা, ঠাকুর দাদার ব্যবসা হিসেবে আমি এখনও ধরে আছি। সবাই কিন্তু এ কাজ করতে পারেননা, এটা একটা শিল্প। কারিগর পাওয়া যায় না এখন আর নতুন করে। ফলে এ ব্যবসার অবস্থা বর্তমান বাজারে খুব খারাপ যাচ্ছে। তবে কোরবানির ঈদ আসলেই আমাদের কদর বাড়ে। কাজ করে কুল পাইনা, এত কাজ আসে।

দরদামের ধারণা দিয়ে তিনি আরও বলেন, কোরবানির ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে চাপাতি, চাকু ও ছুরির। এক চাপাতি ৮০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হয় বর্তমান বাজারে। এছাড়া চামড়া ছোলানোর ছুরি ২৫০ থেকে মানভেদে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। জবাই করা বড় ছুরি ৫০০ টাকার মধ্যে, এছাড়া দা, বটি ৪০০ থেকে ৮০০ টাকায় পাওয়া যায়। আগে এগুলোর সব কিছুর দাম আরও অনেক কম ছিল। তবে বর্তমানে সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম বাড়াতে হয়েছে এসবের।

রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার কামারপট্টির কামার শিল্পী সুশান্ত কুমার বলেন, আগে ব্যবসা ভালোই চলত কিন্তু বর্তমান বাজারে ব্যবসা খুব খারাপ। এখন আমাদের ব্যস্ততা বহুগুণে বেড়েছে। ঈদের জন্য চুক্তিভিত্তিক কারিগর এনেছে অনেকে, সব কামারের দোকানে চলছে ব্যস্ততা। ঈদের আগের রাত পর্যন্ত এ ব্যস্ততা চলবে।

এদিকে রাজধানীর ভাটারা এলাকায় কামার পট্টির দোকানে চাপাতি বানিয়ে নিতে এসেছেন গুলশানের বাসিন্দা মকিদুর রহমান। আলাপকালে তিনি জানান, গুলশানের একটি বাসায় তিনি কেয়ারটেকার হিসেবে কর্মরত আছেন। মূলত ওই বাসার মালিকের কোরবানির জন্যই চাপাতি, ছুরি ও চাকু বানাতে এসেছেন।

মকিদুর রহমান বলেন, দুই বছর আগে যখন এগুলো বানিয়ে নিয়েছি তখন খরচ আরও কম ছিল, এবার চাপাতি বানাতে ২০০/৩০০ টাকা খরচ বেশি চাচ্ছেন তারা। সবগুলো দোকানেই ভিড় দেখছি, সবাই তাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এরমধ্যেই একটা চাপাতি, দুই ধরনের চাকু ও ছুরির অর্ডার দিলাম। আমার স্যার প্রতিবারই এগুলো বানিয়ে নেয় কামারদের কাছ থেকে, কারণ রেডিমেডের থেকে বেশি মজবুত ও দীর্ঘদিন টিকে। তাই সবসময় আমরা এগুলো বানিয়ে নেই।

দুইটি চাপাতি, ছুরি, চাকুসহ পুড়িয়ে শান দিতে দোকানে এসেছেন বনশ্রীর বাসিন্দা সিরজুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিবছর কোরবানির আগে চাপাতি, চাকু, ছুরি বানিয়ে নেই। কিন্তু এবছর দেখলাম আগেরগুলো ভালোই আছে তাই এগুলো পুড়িয়ে শান দেওয়ার জন্য এনেছি। কিন্তু কামারের দোকানগুলোতে সবাই এত ব্যস্ত যে রিপিয়ারিংয়ের কাজ করতে অনীহা দেখাচ্ছেন তারা। তবুও একটি দোকানে ম্যানেজ করে ৬০০ টাকায় কাজ করিয়ে নিচ্ছি।

এএসএস/এফকে