দেশে ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিভিশন বা আইপি টিভির সংখ্যা ঠিক কত, তা জানে না খোদ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। বেশিরভাগেরই নেই সরকারি নিবন্ধন। নীতিমালা অনুযায়ী সংবাদ প্রকাশ করা না গেলেও বহুদিন ধরেই এ নিয়ম মানছে না অধিকাংশ আইপি টিভি। এছাড়া চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে এসব আইপি টিভির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে ৫টি আইপি টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আরও আইপি টিভি বন্ধ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭ (সংশোধিত ২০২০) এর ৪.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইপি টিভিগুলো কোনোরকম সংবাদ প্রচার করতে পারবে না। তবে এ নিয়ম লঙ্ঘন করে আসছে অধিকাংশ আইপি টিভি। এ বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকবার অভিযোগ দিয়েছে বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (এটকো)। 

এরপর গত ৩ এপ্রিল আইপি টিভিগুলোকে সংবাদ প্রচার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

এতে বলা হয়, ‘এতদ্বারা সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭ (সংশোধিত ২০২০) এর ৪.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইপি টিভিগুলো কোনোরকম সংবাদ প্রচার করতে পারবে না। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত আইপি টিভি এ নীতিমালা লঙ্ঘন করে সংবাদ প্রচার করছে।’

‘এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭ (সংশোধিত ২০২০) লঙ্ঘনকারী আইপি টিভিগুলোকে সংবাদ প্রচার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট আইপি টিভির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এ নির্দেশনার পরেও নীতিমালা মানছিল না আইপি টিভিগুলো। এরপর গত ১৮ জুন দেশের সকল জেলা প্রশাসককে চিঠি পাঠায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। চিঠিতে নিয়ম অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। 

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ২৫ জুন চট্টগ্রামে অনিবন্ধিত চার আইপিটিভি অফিসে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এহসান মুরাদ ও হিমাদ্রী খীসা এ অভিযান পরিচালনা করেন। 

এ সময় ক্যামেরাসহ বিভিন্ন ডিভাইস জব্দের পাশাপাশি টিভি অফিসগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়। এছাড়া ২৪-টিভি নামে একটির অফিস থেকে বিপুল পরিমাণ ভেজাল মসলা, ভোজ্য তেল, হেয়ার অয়েল ও মধু পাওয়া যায়। বন্ধ হওয়া বাকি তিনটি আইপিটিভি হলো, সি প্লাস, সিভিশন ও দৈনিক অর্থনীতি।

জেলা প্রশাসন জানায়, নগরের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছুদিন ধরে গড়ে ওঠেছে অবৈধ আইপিটিভির রমরমা ব্যবসা। জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা এবং জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার নির্দেশনা লঙ্ঘন করে গড়ে ওঠা এসব অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের  নির্দেশনায় অভিযান চালানো হয়। 

জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. তৌহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিলগালা করে দেওয়া এসব অনলাইন চ্যানেলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে গণ্যমান্য ব্যক্তির চরিত্রহনন, ব্ল্যাকমেইলিং করে চাঁদাবাজি এবং অবৈধ ব্যবসা কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। বেআইনিভাবে গড়ে ওঠা এসব টিভি অফিস সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।

এরপর গত ২৬ জুলাই চট্টগ্রাম নগরে গড়ে ওঠা চট্টলা টিভি নামে আরেক আইপিটিভি কার্যালয়ে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম এবং হিমাদ্রী খীসা এ অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় অননুমোদিত অনলাইন টিভি কার্যালয়টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। 

জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, নীতিমালা লঙ্ঘন করে করে এসব ভুঁইফোড় অনলাইন সংবাদ গড়ে উঠেছে। এসব বন্ধে জেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ এবং বৈধ হয়েও যারা নীতিমালা লঙ্ঘন করছে, সেসব আইপি টিভির বিরুদ্ধে আরও অভিযান পরিচালনা করা হবে। 

এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠছে আইপি টিভি। এরা নীতিমালার তোয়াক্কা করে না। অধিকাংশ আইপি টিভির কর্তৃপক্ষ চাঁদাবাজির সাথে জড়িত। 

তিনি বলেন, অনেক আইপি টিভির কর্তৃপক্ষ প্রতিনিধিদের কার্ড নিয়ে বাণিজ্য করে। অর্থাৎ টাকার মাধ্যমে প্রতিনিধি বানায়। যেখানে আইপি টিভিতে সংবাদ প্রকাশ করা নিষিদ্ধ, সেখানে কীভাবে সংবাদের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়? এছাড়া তারা গাড়ি এবং বাইকে আইপি টিভির লোগো লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়ায়। এসব অবৈধ কাজ বন্ধে জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে অভিযান চালানোর জন্য। নির্দেশনার আলোকে চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে ৫টি আইপি টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সারাদেশে এ রকম আরও অভিযান চালানো হবে। যেসব আইপি টিভি নিয়ম মানবে না, সেসব বন্ধ করে দেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোকে মাসে বিটিআরসিকে ২০ লাখ টাকার বেশি ফি দিতে হয়। সরকার ৫০টি মতো টিভি চ্যানেলের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে, এর মধ্যে ৩৬টি টিভি সম্প্রচারে আছে। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে দেখবেন তারা (অবৈধ আইপি টিভি) টেলিভিশন চ্যানেলের মতোই বুম নিয়ে হাজির হয়। এদের কোনো অনুমোদন নেই। এরা চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত। 

সম্প্রচার নীতিমালা অনুযায়ী, আইপি টিভি বা ইউটিউব চ্যানেলে সংবাদ প্রচার করা যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেকের পক্ষে সংবাদ প্রকাশ করার জন্য চাঁদা নেয়, বিপক্ষে সংবাদ করার হুমকি দিয়ে চাঁদা নেয়। এ কাজগুলো সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় ঘটছে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে অভিযান চালানোর জন্য। যাদের বৈধ লাইসেন্স নেই, যারা চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।’

‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে তারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়ার জন্য উল্টো টাকা নেয় এবং মাসে মাসে তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা পাঠাতে হয়। এই অবৈধ কাজ-কারবার বন্ধ হওয়া প্রয়োজন, সে কারণে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি’, বলেন তথ্যমন্ত্রী।

এসএইচআর/এসকেডি