২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে সারাদেশে বোমা হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নিজেদের সামর্থ্যের জানান দিয়েছিল। গুলশানের হলি আর্টিসান হামলায়ও জড়িয়েছিল তাদেরই একাংশ নব্য জেএমবি। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযান ও ব্যাপক তৎপরতায় দুর্বল হয়ে পড়া জঙ্গি সংগঠনটি ফের সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডাকাতির মাধ্যমে আর্থিকভাবে সচল হওয়ার চেষ্টাও করছে নিষিদ্ধ সংগঠনটি।

রাজধানীর তেজগাঁও, হাতিরঝিল, শেরেবাংলা নগর এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় গত বছরের ২০ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৭ মার্চ পর্যন্ত ছয়টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। চাঞ্চল্যকর এসব ডাকাতির ঘটনায় জেএমবির সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

সোমবার (২৯ মার্চ) সন্ধ্যায় তেজগাঁও থানাধীন তেজতুরী বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে আসিফুর রহমান আসিফ (২৬) ও পিয়াস শেখ (২৮) নামের জেএমবির দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা তেজগাঁও জোনাল টিম। এ দুজনকে গ্রেফতারে সক্ষম হলেও পালিয়ে যান আরও ৭/৮ জন। গ্রেফতারদের কাছ থেকে বিদেশি পিস্তল ও দুই রাউন্ড গুলি, চারটি মোবাইল ও নগদ ৩৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। ডাকাতির মাধ্যমে ফান্ড গঠন করে জেএমবিকে আর্থিকভাবে সক্রিয় করার প্রয়াসের কথা জানান গ্রেফতার দুজনই।

গ্রেফতার আসিফুর রহমান আসিফ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, জেলখানায় অবস্থানরত জেএমবির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। তাদের নির্দেশে সংগঠনটির সক্রিয় সদস্য আনোয়ার আলী ওরফে হৃদয় (২৮), হাফিজুল শেখ ওরফে সকাল (৩৫), সোহেল, আবু সালেহসহ অজ্ঞাত জঙ্গিরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করছে।

জঙ্গি ডাকাতরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), আওয়ামী লীগের নেতা, অমুসলিম, ইসলাম বিদ্বেষী ও তাদের সহযোগী, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ইত্যাদি ব্যক্তির বাসায় টার্গেট করে ডাকাতির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করছেন। এই অর্থের একটি অংশ জেলখানার কর্তব্যরত কতিপয় ব্যক্তি ও অন্যান্য মাধ্যমে জেএমবির গ্রেফতার শীর্ষ নেতাদের কাছে পাঠানো হয়। অবশিষ্ট টাকা দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত জেএমবি সদস্যদের কাছে আনোয়ার আলী ওরফে হৃদয়, তানজিল বাবু ও হাফিজুল শেখ ওরফে সকালের মাধ্যমে পৌঁছানো হয়।

আসিফুর রহমান আসিফের কাছ থেকে পাওয়া ৩৫ হাজার টাকা কাশিমপুর কারাগারে থাকা কয়েকজন জঙ্গি নেতার কাছে পাঠানোর জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে জানান তিনি।

জিজ্ঞাসাবাদে আসিফ আরও জানান, ডাকাতি করা অর্থ দিয়ে ‘হালাল ও ফ্রেশ’ নামের খাবার সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে তারা জঙ্গি অর্থায়ন, পৃষ্ঠপোষকতা ও সংগঠনের সদস্য সংগ্রহের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

গ্রেফতাররা জেএমবির সক্রিয় সদস্য উল্লেখ করে তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ওয়াহেদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সোমবার (২৯ মার্চ) গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি, তেজতুরী বাজার এলাকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির কয়েকজন সদস্য নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনার উদ্দেশে সমবেত হয়েছেন। ওই স্থানে অভিযান পরিচালনা করে অস্ত্র-গুলিসহ তাদের হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় অজ্ঞাত কয়েকজন পালিয়ে যান।’

তিনি বলেন, ‘তেজগাঁও বিভাগের হাতিরঝিল, শেরেবাংলা নগর এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় গত বছরের ২০ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৭ মার্চ পর্যন্ত ৬টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় এ পর্যন্ত ডাকাতি করা কিছু স্বর্ণ, টাকা উদ্ধারসহ ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে চার জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।’

গ্রেফতার আসিফুর রহমান আসিফ ও পিয়াস শেখ

ডিসি ওয়াহেদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেফতার দুই জেএমবি সদস্য আসিফুর রহমান আসিফ ও পিয়াস শেখ অন্যান্য ডাকাত ও তাদের সংগঠনের সঙ্গে মিলে এসব ডাকাতির ঘটনায় সম্পৃক্ততার কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন। সেইসঙ্গে তারা কয়েকজন ডাকাতের নামও জানিয়েছেন।’

ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘তাদেরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় দুর্বল হয়ে পড়া নিষিদ্ধ জেএমবি ফের সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। কারাগারে থাকা নেতাদের জামিনে বের করে আনা, নামি আইনজীবী নিয়োগ ও সংগঠন পরিচালনায় অর্থ সংগ্রহের জন্যই তারা মূলত ডাকাতির কাজ শুরু করেন। তাদের বাকি সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তাদের কাছ থেকে কয়েকজনের তথ্য ও নাম পাওয়া গেছে। এর আগে ডাকাতির মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা ও জামিন পাওয়াদের ফের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

তিনি বলেন, ‘গ্রেফতার দুজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। সেই মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি পলাতক জেএমবি সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।’

জানা গেছে, পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে গ্রেফতার এ দুই জঙ্গির চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। মঙ্গলবার (৩০ মার্চ) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরী শুনানি শেষে রিমান্ডের এ আদেশ দেন।

এর আগে, গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে মহাখালী থেকে সংগঠনটির দস্যুতা শাখার অন্যতম সদস্য মোজাফফর আলী ওরফে শাহীনকে (৩৫) গ্রেফতার করে ডিএমপি। সে সময় পুলিশ জানিয়েছিল, দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে থাকা সংগঠনটির শীর্ষ নেতা সালাহউদ্দিন সালেহীন বিভিন্ন মাধ্যমে তার অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও আর্থিক অনটন কাটাতে সংগঠনটি নতুন করে দস্যু বাহিনী গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৯ সালে সংগঠনটিতে যোগ দেন শাহীন। দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও শারীরিক প্রশিক্ষণ নেন। সংগঠনে যোগদানের পর থেকে রিক্রুটমেন্ট এবং অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু করেন তিনি। জেএমবি সদস্যরা অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সময় ডাকাতি ও ছিনতাই শুরু করেন। ২০১৪ সালে জেএমবির সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল ত্রিশালে পুলিশের প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে সংগঠনটির তিন নেতা সালাহউদ্দিন সালেহীন, বোমা মিজান ও হাফিজ মাহমুদকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকেই শাহীন আত্মগোপনে চলে যান।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারা জানান, ধারাবাহিক অভিযানে জেএমবির অধিকাংশ নেতাকর্মী ধরা পড়ে, সাজা হয়। নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে জেএমবির সাংগঠনিক কার্যক্রম। তবে নব্য জেএমবি গুলশান হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলার মধ্য দিয়ে তাদের সাংগঠনিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পুনরুত্থান ঘটে। পরে এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা র‌্যাব-পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালের শেষের দিকে জেএমবির নতুন আমির আবু রায়হান ওরফে মাহমুদ ওরফে আবদুল হাদিসহ হাবিবুর রহমান ওরফে চাঁন মিয়া ও রাজিবুর রহমান ওরফে রাজিবকে গ্রেফতার করা হয়। হাবিবুর ২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় এক পীরের বাসায় ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া মুন্সিগঞ্জে শাহজাহান বাচ্চু হত্যাকাণ্ডেও তার সম্পৃক্ততা ছিল।

এর আগে, ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল আশুলিয়ার কাঠগড়ায় বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের একটি শাখায় ডাকাতি করতে গিয়ে গুলি, বোমা হামলা ও ছুরিকাঘাত করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপকসহ আট জনকে হত্যা করা হয়। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে, তহবিল সংগ্রহের জন্য জেএমবি সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন।

পরের বছর ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর রাজধানীর তেজগাঁও থেকে ডাকাতির মালপত্রসহ জেএমবির সন্দেহভাজন সাত সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। সে সময় সিটিটিসি জানায়, কারাবন্দি নেতাদের জামিনে ছাড়াতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্যরা ডাকাতি করছেন।

জেইউ/এফআর