# দেশের প্রথম ক্যাশলেস এবং ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত জেলা পঞ্চগড়
# বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় শতভাগ মানুষ 
# প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩১০টি থেকে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৬৪টি
# ২০০৬ সালে বয়স্ক ভাতাভোগী ১০,০২০, ২০২৩ সালে ৪৫,২০১ জন
# ঢাকার সঙ্গে পঞ্চগড়ের সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ
# চা বিক্রি থেকে আয় ২৮০ কোটি (২০২২-২৩)

দেশের শেষ সীমানা পঞ্চগড়। অভাব-অনটন আর অনুন্নত জেলা হওয়ায় কারণে এক যুগ আগেও ‘মঙ্গাপীড়িত’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল এটি। তবে বিগত কয়েক বছরে অভূতপূর্ব উন্নয়নের কারণে দেশের অন্যান্য জেলার রোল মডেলে পরিচিতি লাভ করেছে পঞ্চগড়। এ সময়টায় এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হয়েছে, ঠিক একইভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রযুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, সামাজিক নিরাপত্তা ও রেলপথসহ যোগাযোগের সব সূচকেই অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। 

২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবহেলিত এই জেলায় উন্নয়নের ধারা শুরু হয়। এরপর থেকে বদলে গেছে এ জেলার চিত্র। ২০০৬ সালে এ জেলায় মাত্র ৪৪ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল। যেখানে ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে শতভাগ মানুষ। পঞ্চগড়ে ২০০৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল মাত্র ৩১০টি। বর্তমানে এ সরকারের শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণ নীতি বাস্তবায়নের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৬৪টি। এ জেলার একমাত্র ১০০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালকে আটতলা বিশিষ্ট ২৫০ সজ্জার আধুনিক হাসপাতালে উন্নীত করা হয়েছে। এ জেলার তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা স্থল বন্দরটি বাংলাদেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর। যার মাধ্যমে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া ছিটমহল বিনিময়ের মতো বড় সাফল্য ভোগ করছে এ জেলার মানুষ। এভাবে সব সূচকেই অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে পঞ্চগড় জেলায়। 

পঞ্চগড় জেলার উন্নয়ন প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী পঞ্চগড়ের বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখেন। তিনি এখানকার জেলার উন্নয়নে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তাই আজকে দেশের মধ্যে উন্নয়নের রোল মডেল হলো পঞ্চগড়। 

তিনি বলেন, পঞ্চগড়ে আগামী এক মাসের মধ্যে দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র করা হচ্ছে। এতে করে এখানকার সমতলের চা চাষীরা লাভবান হবে এবং চা উৎপাদন আরও বাড়বে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ সব ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে পঞ্চগড়, যা হয়ত অনেকে না দেখলে বিশ্বাস করতে চাইবে না। কারণ এক সময় পঞ্চগড়কে মানুষ অবহেলিত ও মঙ্গাপীড়িত হিসেবে জানত। তবে এখন ধনী জেলা পঞ্চগড়। 

শিক্ষা খাতে ব্যাপক উন্নয়ন

১৯৭২ সালে পঞ্চগড় জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ৩০০টি। ২০০৯ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৩১০টিতে। বর্তমান সময়ে এ সরকারের শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণ নীতি বাস্তবায়নের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৬৪টিতে। বর্তমানে পঞ্চগড়ে শিক্ষার হার ৭৪ শতাংশ। ২০০৮ সালে যা ছিল মাত্র ৪৮.৩৬ শতাংশ। ২০০৬ সালে ঝরে পড়া প্রাথমিক শিক্ষার্থীর হার ছিল ১৭.০৮ শতাংশ। বর্তমানে যা মাত্র ৩.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ছিটমহল বিনিময়ের পর এ জেলার আওতাধীন ৩৬টি ছিটমহলে নতুন করে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাত

২০০৬ সালে পঞ্চগড় জেলার চার উপজেলায় ৩১ শয্যাবিশিষ্ট চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছিল। বর্তমানে জেলায় চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এছাড়া জেলার একমাত্র ১০০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালকে আট তলা বিশিষ্ট ২৫০ শয্যার আধুনিক হাসপাতালে উন্নীত করা হয়েছে। 

গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন

পঞ্চগড় জেলায় অবকাঠামো উন্নয়নে গত দুই দশকের কম সময়ে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। সড়ক ও জনপদ বিভাগের আওতাধীন ৭২ কি.মি. রাস্তা প্রশস্তকরণের মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে-২ এর উপযুক্ত করে নির্মাণ করা হয়েছে। 

এছাড়া ২০০৮ সাল পর্যন্ত এলজিইডির আওতায় ৩০৫ কি.মি উপজেলা সড়ক নির্মিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়ে এলজিইডির মাধ্যমে ৭৯০ কি.মি দৈর্ঘ্যের ৬৯০টি পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়। যার ফলে এ জেলায় মোট পাকা সড়কের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০৯৫ কি.মি.। একইভাবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলায় নির্মিত ব্রিজ/কালভার্টের সংখ্যা ছিল ৪৮৮টি (মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ হাজার ৬৮৫ মিটার)। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়ে এলজিইডি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের মাধ্যমে আরও ৪৯২টি ব্রিজ/কালভার্ট (মোট দৈর্ঘ্য ১১ হাজার ৭৪২ মিটার) নির্মাণ করা হয়। যার ফলে মোট ব্রিজ/কালভার্টের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮০টি (মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৩ হাজার ৪২৭ মিটার)। এছাড়া এ জেলায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন ভবন নির্মাণ করে ৩৭টি হাঁট-বাজারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়েছে।

বিদ্যুতের আওতায় শতভাগ মানুষ

বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির নানামুখী উদ্যোগের ফলে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ থেকে নেসকো ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে ইতোমধ্যে এ জেলার শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ২০০৬ সালে মাত্র ৪৪ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল। যেখানে ২০২৩ সালে শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে ছয় হাজার ১৭৫ কি.মি দীর্ঘ সার্ভিস লাইন রয়েছে, যা ২০০৬ সালে ছিল মাত্র ৯৭৫ কি.মি.। বর্তমানে দুই লাখ ৭৩ হাজার ৫৪৩ জন গ্রাহক থাকলেও ২০০৬ সালে গ্রাহক ছিল মাত্র ২৮ হাজার ৩০৫ জন।

রেল যোগাযোগের যুগে প্রবেশ

২০০৬ সালের আগে পঞ্চগড় জেলার সঙ্গে সরাসরি ঢাকার ট্রেন যোগাযোগ ছিল না। যে কয়েকটি খাতে অভূতপূর্ব এবং স্মরণীয় পর্যায়ে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তার মধ্যে রেলওয়ে যোগাযোগ খাত অন্যতম। এ জেলায় রেল ট্র্যাক নির্মাণ, রেল যোগাযোগে নতুন কোচ চালুকরণ ও আধুনিক রেলওয়ে প্লাটফর্ম নির্মাণ ইত্যাদি খাতে বিগত ২০ বছরে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে পঞ্চগড়ের সঙ্গে অন্য জেলার আধুনিক রেল যোগাযোগ স্থাপনের জন্য মোট ছয়টি ট্রেন চলাচল করছে। ২০১৯ সালে পঞ্চগড় জেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের নামে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত দৃষ্টিনন্দন একটি রেলওয়ে স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া হয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় রেল যোগাযোগের জন্য আধুনিক রেলওয়ে ট্র্যাক নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর চার দেশের ব্যবসা কেন্দ্র

তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা স্থল বন্দরটি বাংলাদেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর। যার মাধ্যমে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রতিদিন এ স্থলবন্দরে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করে। ফলে জীবন-জীবিকায় এ বন্দরের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভর করে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ। ১৯৯৭ সালের দিকে প্রথম নেপালের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার্থে এ বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে ভারত এবং ২০১৭ সালে ভুটানের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়। 

এর আগে ২০১৬ সালে এ বন্দরের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন চালু হয়। এ বন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে পাথর, ভুট্টা, ওয়েল কেক, আদা, গম, চাল, ফল এবং নেপাল ও ভুটান থেকে উৎপাদিত ও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পণ্য আমদানি করা হয়। এছাড়া দেশ থেকে পার্টস, গ্লাস শিট, ওষুধ, আলু, জুস, কটন ব্যাগ ও খাদ্য সামগ্রী রপ্তানি করা হচ্ছে। বর্তমানে এ বন্দরের কলরব আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে এটিকে একটি আধুনিক বন্দরে রূপান্তরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করা হয়েছে, যার বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মহসিন আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েক বছর আগে এ বন্দরটি নামেই বন্দর ছিল। এত উন্নত ছিল না। আমাদের অনেক দুঃখ ছিল সেসময়। দেশের নিকটেই ভারত অথচ এদিক দিয়ে আমরা সেখানে যেতে পারতাম না। এখন আমরা যেতে পারছি। এটা হওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে।

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি বাংলাদেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারত, ভুটান ও নেপাল। আমদানি-রপ্তানি ছাড়াও মানুষ বন্দরটি ব্যবহার করে ভারত, ভুটান ও নেপালে যাচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর প্রভাব খুবই উল্লেখযোগ্য। এখানে বন্দরকেন্দ্রিক প্রায় ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

সামাজিক নিরাপত্তা খাত

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সালে বয়স্ক ভাতাভোগী ছিল ১০ হাজার ২০ জন। ২০২৩ সালে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ২০১ জন। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা ২০০৬ সালে পেত ছয় হাজার ৭৪০ জন। ২০২৩ সালে তা চার গুণ বেড়ে হয়েছে ২৩ হাজার ৫৭১ জন। ২০০৬ সালে পঞ্চগড়ে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পেত এক হাজার ২৭০ জন। বর্তমানে পাচ্ছে ১৬ হাজার ৫২৮ জন। 

চা শিল্পে বদলে গেছে পঞ্চগড়

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে ১৯৯৬ সালে প্রথম সমতলে চা চাষের স্বপ্ন দেখেন পঞ্চগড়বাসী। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে এ জেলায় চা চাষের সূত্রপাত হয়। ২০০৬ সালে চা আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯২৫ একর। বর্তমানে যা ১৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১২ হাজার ৭৯ একর। বছরে এ শিল্প হতে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা আয় হচ্ছে, যা চা খাতে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়। ২০০৬ সালে এ খাতে আয় ছিল এক থেকে দেড় কোটি টাকা। ২০০৯ সালে এ জেলার মোট চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৫৯ লাখ কেজি। ২০২২ সালে যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে এক কোটি ৭৮ লাখ কেজি। ২০০৬ সালে যেখানে মাত্র এক হাজার ৪৭৫ জন শ্রমিক এ শিল্পে জড়িত ছিল। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে।

তেঁতুলিয়া উপজেলার চা চাষী মমতাজ বেগম বলেন, আগে ধান চাষ করতাম। কিন্তু এখন চা চাষ করে অনেকটাই স্বাবলম্বী। আগে বছরে যে ধান পেতাম তা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। এখন চা চাষ করায় তেমন কষ্ট হচ্ছে না। আমার মতো ছোট চা চাষীদের যাদের ফ্যাক্টরি নেই, তারা অন্যদের ফ্যাক্টরিতে পাতা বিক্রি করে থাকি। প্রধানমন্ত্রীর জন্য আমাদের ভাগ্য বদল হয়েছে।

জেলা প্রশাসন কার্যালয় জানিয়েছে, গত ১৪ বছরে বদলে গেছে পঞ্চগড়ে চা শিল্প। এ জেলায় একটি কারখানা থেকে হয়েছে বর্তমানে একাধিক কারখানা। দেশের অর্থনীতিতেও বিরাট অবদান রাখছে এখানকার চা শিল্প।

উল্লেখ্য, পঞ্চগড়ের সমতলের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই এ জেলায় দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র চালুর ঘোষণা দিয়েছেন, যা খুব শিগগিরই উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। 

ছিটমহল বিনিময়

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৭৪ সালে সই করা স্থল সীমানা চুক্তি এবং ২০১১ সালের প্রটোকল কার্যকরের পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চগড় জেলার ৩৬টি ছিটমহল (৩১ জুলাই ২০১৫ মধ্যরাত থেকে) বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ৩৬ ছিটমহলের ১১ হাজার ৯৩২.৭৮ একর জমিতে মোট জনসংখ্যা ১৯ হাজার ২৪৩ জন।

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে ছিটমহলে কোনো ধরনের উন্নয়ন না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ছিটমহলে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক বিলুপ্ত ছিটমহলের জমির ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ফাইনাল খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়। ইতোমধ্যে পঞ্চগড় জেলার ছিটমহলে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তিনটি মহাবিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে। 

এছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ হতে পাঁচটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। এলজিইডি কর্তৃক ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০২ কি.মি. পাকা রাস্তা, ১১ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি ব্রিজ-কালভার্ট, ১১টি মসজিদ, চারটি মন্দির, পাঁচটি বাজার, একটি কবরস্থান ও দুটি নদীর ঘাটলা নির্মাণ করা হয়েছে।

পল্লি বিদ্যুৎ সমিতি কর্তৃক ২৩৮ কি.মি. বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন এবং আট হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আট কোটি টাকা ব্যয়ে ভাউলাগঞ্জে একটি সাব স্টেশন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলে অত্যাধুনিক ডিজিটাল সার্ভিস এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (ডি-সেট) সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এ জেলার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে মোট ৩৪৯টি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।

বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা আক্কাস আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনিশ্চয়তার জীবন থেকে আমাদেরকে একটি পরিচয়ের সুযোগ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা এখন বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা এখন ভোটও দেই। 

ভূমিহীন ও গৃহহীন জেলা পঞ্চগড়

মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর উপহার দেওয়ার মাধ্যমে পঞ্চগড় দেশের প্রথম শতভাগ ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত জেলা হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছে। আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের ১ম, ২য় ও ৩য় পর্যায়ের মাধ্যমে মোট চার হাজার ৮৫০ জন ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর দিয়েছে সরকার। ২০২২ সালের ২১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী পঞ্চগড় জেলাকে দেশের প্রথম ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

ক্যাশলেস সেবায় খুশী মানুষ 

২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এজন্য শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায় ডিজিটাল সেবার আওতা বাড়ানো হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় পঞ্চগড়ের প্রতিটি ইউনিয়নকে ক্যাশলেস ইউনিয়ন করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। জেলার ৪৩টি ইউনিয়ন পরিষদ ও তিনটি পৌরসভার নাগরিকরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ঘরে বসে পাচ্ছেন নানা সেবা।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৪৩টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভার নাগরিকরা যাতে ঘরে বসেই বিভিন্ন সেবা পেতে পারেন সেজন্য আমরা ক্যাশলেস ইউনিয়ন সেবা চালু করেছি। এতে পঞ্চগড় মডেল জেলা হিসেবে ইতোমধ্যে সারাদেশে পরিচিতি পাচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রান্তিক মানুষ যাতে ঘরে বসেই জন্ম সনদ, মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশ সনদ ও অবিবাহিত সনদসহ অন্য যেসব সেবা রয়েছে সেগুলো পেতে পারে সে ব্যবস্থা আমরা করছি।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ক্যাশলেস ইউনিয়ন ট্যাক্স এবং সেবা সিস্টেম বাস্তবায়নে দুটি সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। এ দুটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে জেলার ৭০ হাজার নাগরিককে বিভিন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে। এতে সেবা গ্রহণে তাদের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সেবায় (সনদ, রসিদ) কিউআর (ছজ) কোড থাকায় সেবার সঠিকতা যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে। এ উদ্যোগটি চালুর ফলে হয়রানিমুক্তভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। বিশেষ করে সনাতন পদ্ধতিতে সেবা দানকালে রশিদের মাধ্যমে নগদ অর্থ ইউনিয়ন পরিষদ গ্রহণ করত। নগদ অর্থ হওয়ায় তা নিয়মিত ইউনিয়ন পরিষদের ব্যাংক হিসাবে সঞ্চয় করা হতো না, বা অনেক সময় আদায় রেজিস্টারে তা রেকর্ড করা হতো না। কিন্তু ডিজিটাল এবং ক্যাশলেস ইউনিয়ন সেবা চালুর পর ডিজিটাল পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে সেবামূল্য পরিশোধ করার ফলে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের অর্থ তছরুপের কোনো সুযোগ নেই।

যেহেতু সেবা গ্রহণের জন্য সেবা গ্রহীতাকে ইউনিয়ন পরিষদে আসার প্রয়োজন নেই, ফলে এই উদ্যোগটির বড় ধরনের আর্থসামাজিক প্রভাব রয়েছে। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদে সবচেয়ে বেশি সেবাগ্রহীতা সেবা গ্রহণের জন্য আসেন, এ উদ্যোগের ফলে তাদের উপস্থিতি হ্রাস পেয়েছে বা ক্ষেত্রবিশেষে শূন্য হয়েছে।

তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ক্যাশলেস সেবাগ্রহণকারী মাজহারুল আনোয়ার সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি ট্রেড লাইসেন্স করেছি। অনলাইনে আবেদন করে সে আবেদনের অর্থও বিকাশে পেমেন্ট করেছি। নগদ কোনো টাকা পেমেন্ট করতে হয়নি। ক্যাশলেস করার মাধ্যমে আমরা অনেকগুলো সমস্যা থেকে সমাধান পেয়েছি। এখন আর বাড়তি টাকা রাখার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার কারণে আমরা এ সুফল ভোগ করছি।

তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মনসুর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের ১৯টি সেবা আমরা ক্যাশলেসের মাধ্যমে দিয়ে থাকি। এতে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আমাদের কোনো সার্টিফিকেট নিতে এখন আর নগদ টাকা দিতে হচ্ছে না। অনলাইন ডিজিটাল সেবা পাওয়ার জন্য সরাসরি মোবাইলে আবেদন করা যাচ্ছে। নগদ কিংবা বিকাশের মাধ্যমে সরকারি অ্যাকাউন্টে সরাসরি এ অর্থ চলে যায়। টাকা কম-বেশি নেওয়ার কোনো সুযোগ আর নেই। হোল্ডিং ট্যাক্সও ক্যাশলেসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হচ্ছে।

এমএসআই/কেএ