চট্টগ্রামের মিতু হত্যা মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন কাজী আল মামুন নামে একজন। মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে তিনি সাক্ষ্য দেন।

আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া মামুন নড়াইলের লোহাগাড়া থানার খলিসাখালি গ্রামের বাসিন্দা। তার নাসিম টিউটোরিয়াল নামে একটি কোচিং সেন্টার আছে। তিনি ‘দৈনিক বাংলাদেশের আলো’ নামে একটি জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি।

সাক্ষ্যতে মামুন বলেন, ‌‘কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা আমার সাবেক স্ত্রী আবেদা জান্নাত মিম এর আপন খালু। আত্মীয়তার সুবাদে ২০১৬ সালের শুরুর দিকে মুছা সপরিবারে আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তখনই মুছার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও পরিচয়। সেই সুবাদে মাঝে মাঝে মুছা আমার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল নম্বর ও মিমের নম্বরে ফোন করতেন। এরপর ২০১৬ সালের জুন মাসের শুরুর দিকে তার ব্যবহৃত মোবাইল যার শেষ  ৯১ নম্বর, সেটি থেকে আমাকে ফোন দেন। ফোন করে বলেন, তোমার নম্বর বিকাশ আছে? আমি বলি, আমার দুটি নম্বরই বিকাশ করা। পাল্টা জানতে চাই, আঙ্কেল আমার বিকাশ নম্বর কেন চাচ্ছেন? তখন তিনি বলেন, এসপি স্যারের এক লোক আমাকে কিছু টাকা পাঠাবে। তখন আমি আবার বলি, আপনার টাকা আমার কাছে কেন পাঠাবে? তখন তিনি বলেন, আমি (মুছা) চিটাগাং এ নাই। বাইরে আছি। তিনি বলেন, তুমি ক্যাশ করে রাখো। আমার কোনো লোক পরে পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করলে (বিকাশ নম্বর দিলে) তুমি টাকাগুলো বিকাশ করে দিও।’ 

‘এরপরে ২০১৬ সালের ১০ জুন সন্ধ্যার দিকে আমাকে ফোন করা হয়। শেষ ডিজিট সম্ভবত ৩১। ফোন করে এক লোক বলেন, আমি মুছাকে চিনি কিনা? তখন আমি বলি, হ্যাঁ, মুছা আমার আত্মীয়। তাকে আমি চিনি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি কে? তখন তিনি বলেন, আমি মুছা এবং এসপি বাবুল আক্তার স্যারের পরিচিত লোক। তিনি বলেন, মুছা আপনার কাছে কিছু টাকা পাঠাতে বলেছে, আপনার বিকাশ নম্বর দেন। তখন আমি নিজের উল্লেখিত দুটো ফোন নম্বর তাকে দিই। উনি বলেন, দুটো নম্বরে তো ২৫-২৫ করে ৫০ হাজার টাকা যাবে। আমি আপনাকে টাকা পাঠাব ১ লাখের মত। আপনি আরও একটি নম্বর দেন। পরে আমার বন্ধু মোস্তাইনের দোকান আছে (বিকাশ এজেন্ট) তার নম্বরটি দিই। সেই নম্বরটি এখন মনে নেই। কিছু সময় পরে আমার দুটি নম্বরে ২৫-২৫ করে মোট ৫০ হাজার এবং মোস্তাইনের বিকাশ এজেন্ট নম্বরে ৪৯ হাজার টাকা আসে। দোকানের নম্বরে আসা টাকাটা আমি ক্যাশ করে নিয়ে যাই। আমার দুটি নম্বরে থাকা টাকা মোবাইলেই থাকে।’

‘এর দুই দিন পরে এক লোক মুছার রেফারেন্স দিয়ে বলে আমি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে বলছি। নাম বলেছিল, এ মুহূর্তে স্মরণ নেই। তোমার কাছে যে টাকাগুলো পাঠিয়েছিল তা পাঠিয়ে দাও। কয়টা ফোন নম্বর দিয়েছিল এখন তা মনে নেই। আমার নিজের মোবাইলে যে টাকাগুলো ছিল সেগুলো ট্রান্সফার করে দিই। আর নগদ টাকা থেকে ১৮ হাজার ৫০০ টাকা মোস্তাইনের দোকান থেকে আরেকটি ফোন নম্বরে বিকাশ করে পাঠিয়ে দিই। অবশিষ্ট ৩১ হাজারের কিছু বেশি টাকা (ওইদিন বা পরের দিন) আরেকটি নম্বর দিলে সেটিতে পাঠিয়ে দিই।’

‘পরে ২০২১ সালের ১০ মে আমাকে পিবিআই গ্রামের বাসা থেকে নিয়ে আসে। যশোর পিবিআই অফিসের একজন কর্মকর্তা স্নেহাশীষ ফোন দেন। তখন আমি কোচিং এ পড়াচ্ছিলাম। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে আসে, তারপর বলে সন্তোষ স্যার কথা বলবে। ফোনে আমাকে সন্তোষ কুমার চাকমার সাথে কথা বলিয়ে দেন। সন্তোষ স্যার বলেন, একটা মামলার বিষয়ে তথ্য নেওয়ার আছে। আপনাকে সসম্মানে আনা হবে। যশোরের পিবিআই কর্মকর্তারা আমাকে ঘাটিয়াপাড়া (মধুমতী নদীর তীরে) পর্যন্ত এনে দেন। সেখান থেকে ঢাকা হয়ে পিবিআইর সহায়তায় চট্টগ্রাম পিবিআইতে আসি ১০ মে ২০২১।’  

‘এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমার কাছে মামলার সম্পর্কে আজ যা বলেছি তাই বলি। তখন আমার কাছে যে মোবাইল সেট ছিল একটি অপপো এথ্রিথ্রিএফ এবং সিম্ফনি ১৭২ সেট ও সিমসহ জব্দ করা হয়। আমি জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করি। পরবর্তীতে ১১ মে ২০২১ ম্যাজিস্ট্রেট মো সফিউদ্দিনের কক্ষে আমি জবানবন্দি দিই। এটাই আমার স্বাক্ষর। আমি বাবুল আক্তারকে চিনি না। কখনো দেখিনি।’

চট্টগ্রাম মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আবদুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) মামলাটিতে বাবুল আক্তারের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল ইসলাম সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। এরপর তাকে জেরা শুরু করে আসামি পক্ষের আইনজীবী। আজ (বুধবার) তার জেরা শেষ করে মামুনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এরপর তাকে জেরা শুরু করে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। জেরা শেষ হয়নি। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) জেরা শেষ করা হবে।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। 

তবে মামলাটিতে স্ত্রী হত্যাকাণ্ডে স্বামী বাবুল আক্তারেরই সম্পৃক্ততা পায় পিবিআই। ২০২১ সালের ১২ মে আগের মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। একই দিন বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় দ্বিতীয় মামলাটি দায়ের করেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন। ওইদিনই মামলাটিতে বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করে পিবিআই। সেই থেকে কারাগারে রয়েছেন বাবুল।

এদিকে, প্রথম মামলায় পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর নারাজির আবেদন করেন বাবুলের আইনজীবী। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৩ নভেম্বর নারাজি ও পিবিআইয়ের প্রতিবেদন খারিজ করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। এরপর দুটি মামলাই তদন্ত করতে থাকে পিবিআই। তবে পরবর্তী সময়ে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গত বছরের ২৫ জানুয়ারি মিতুর বাবার দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এরপর একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম মামলাটি অধিকতর তদন্ত শেষে বাবুলসহ ৭ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।

গত ১৩ মার্চ আলোচিত মামলাটিতে বাবুল আক্তারসহ সাত আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।

এমআর/এসকেডি