রাজধানীতে আইনের তোয়াক্কা না করে এভাবে চলে রাস্তা পারাপার, ঘটে দুর্ঘটনা

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় মার্চে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। তবে হতাহতের সংখ্যা সামান্য কমেছে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সোমবারের (৫ এপ্রিল) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্চ মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০৯টি। নিহত হয়েছেন ৫১৩ জন, আহত ৫৯৮। ফেব্রুয়ারিতে ৪০৬টি দুর্ঘটনায় ৫১৭ জন নিহত হন। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির চেয়ে মার্চে এসে নিহতের সংখ্যা কমেছে চারজন। তবে, দুর্ঘটনা বেড়েছে তিনটি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মার্চে নিহতের মধ্যে ৭৮ জন নারী ও ৬৩ শিশু রয়েছে। ৪০৯টি দুর্ঘটনার মধ্যে ১৩৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এতে নিহত হন ১৪৭ জন। যা মোট নিহতের ২৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

বিদায়ী মাসে দুর্ঘটনায় ১৩৬ পথচারী নিহত হয়েছেন। যা মোট নিহতের ২৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৮২ জন। অর্থাৎ ১৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

মার্চ মাসের দুর্ঘটনায় নিহতের চিত্র

এ সময়ে দুটি নৌ-দুর্ঘটনায় দুজন নিহত এবং আটজন আহত হয়েছেন। এছাড়া ১৫টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত এবং ছয়জন আহত হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। সোমবার (৫ এপ্রিল) সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, মূলত ১০ কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। এগুলোর  হচ্ছে- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনার ধরন

প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি যানবাহনের চাপায়-ধাক্কায় পথচারী নিহতের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হারও উদ্বেগজনক পর্যায়ে। সড়কে নিরাপদ চলাচলের বিষয়ে অজ্ঞতা, অবহেলা ও ট্রাফিক আইনের প্রয়োগহীনতা এর প্রধান কারণ। মোটরসাইকেল ক্রয় ও চালানোর ক্ষেত্রে ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ এবং নিয়মিত মনিটরিং নিশ্চিত করতে না পারলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার চিত্র আরও ভয়াবহ হবে। আতঙ্কজনক এমন প্রেক্ষাপটেও সরকার মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ফি কমানো এবং সিসি বা অশ্বশক্তি সীমা উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বৃদ্ধি করবে। এছাড়া ভালোমানের হেলমেট ব্যবহারে অনীহাও ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। বিষয়গুলো আরও গভীরভাবে সরকারের ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

সাইদুর রহমান বলেন, মার্চ মাসে রেল ক্রসিংয়ে তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। দেশে ৮২ শতাংশ রেল ক্রসিং অরক্ষিত। এসব ক্রসিংয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৪২১ জন, অর্থাৎ ৮২ দশমিক ০৬ শতাংশ। চিত্রটি ভয়াবহ! সড়ক দুর্ঘটনায় অসংখ্য পরিবার তার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির নিহত বা পঙ্গুত্বের মধ্য দিয়ে পথে বসছে, হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে। ফলে দেশে আর্থ-সামাজিক সংকট বাড়ছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এর বিধান থাকলেও কোনো সময় এটি কার্যকর ছিল না, বর্তমানেও নেই। সেজন্য কেউ ক্ষতিপূরণ পান না। অথচ অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে সড়ক পরিবহন খাতে বিদ্যমান নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে, যার দায় রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র কোনোপ্রকার দায় নিচ্ছে না। বিষয়টি অমানবিক! সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সরকারের পক্ষ থেকে বারবার কমিটি গঠন ও সুপারিশমালা তৈরি করা হলেও আদতে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। কারণ পুরো খাতটি রাজনৈতিক চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনের চিত্র

যানবাহন ভিত্তিক যাত্রী-চালক নিহতের চিত্র

দুর্ঘটনায় মোট নিহতের মধ্যে মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ১৪৭ জন, বাসযাত্রী ৩০ জন, ট্রাক-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলিযাত্রী ৫১ জন, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকারের যাত্রী ৫০ জন, থ্রি-হুইলারের যাত্রী (সিএনজি-ইজিবাইক-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পো-মিশুক) ৮১ জন, নসিমন-ভটভটি-মাহেন্দ্র-লাটাহাম্বা ও বাইসাইকেলের আরোহী ১৮ জন নিহত হয়েছেন।

দুর্ঘটনার ধরন

দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৯১টি মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৪২টি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৩৪টি পথচারীকে চাপা-ধাক্কা দেওয়া, ২৯টি যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৩টি অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত বা দায়ী যানবাহন

দুর্ঘটনার জন্য দায়ী-ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২৭.৫৪ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি ৬.১৩ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার ৪.০৪ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১১.০৭ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২১.৫৫ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পো-মিশুক) ১৭.৫১ শতাংশ, নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহেন্দ্র-বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা ৮.৯৮ শতাংশ এবং অন্যান্য (মাটিকাটা ট্রাক্টর-ড্রাম ট্রাক-লাটাহাম্বা-তেলবাহী লরি-পাওয়ারটিলার-কন্টেইনার-কোস্টার-ঠেসার) ৩.৫৯ শতাংশ।

দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ দক্ষ চালক না থাকা। এজন্য দক্ষ চালক তৈরিতে গুরুত্ব দিতে বলছেন সংশ্লিষ্টরা

দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনের সংখ্যা

দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনের সংখ্যা ৬৬৮টি। ট্রাক ১২৬টি, বাস ৭৪টি, কাভার্ডভ্যান ২১টি, পিকআপ ৩৭টি, লরি পাঁচটি, ট্রলি ২০টি, ট্রাক্টর ১৬টি, তেলবাহী লরি তিনটি, কন্টেইনার দুটি, ড্রাম ট্রাক তিনটি, মাইক্রোবাস ১৫টি, প্রাইভেটকার ১৭টি, মোটরসাইকেল ১৪৪টি, ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পো-মিশুক ১১৭টি, নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহেন্দ্র-ঠেসার ৪৭টি, বাই-সাইকেল পাঁচটি, প্যাডেল রিকশা নয়টি, লাটাহাম্বা তিনটি ও পাওয়াটিলার চারটি।

আহত ও নিহতদের পেশাগত পরিচয়

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ছয়জন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ১৩ জন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নারী প্রকৌশলী একজন, উপজেলা কার্যালয়ের অফিস সহকারী একজন, উপজেলা স্বাস্থ্য উপ-সহকারী দুজন, আইনজীবী তিনজন, যন্ত্রসংগীত শিল্পী দুজন, স্থানীয় সাংবাদিক চারজন, সংবাদপত্র এজেন্ট একজন, ব্যাংক কর্মকর্তা চারজন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১১ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২৩ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ৪৭ জন, যুক্তরাজ্য প্রবাসী দুজন, পোশাকশ্রমিক সাতজন, ইটভাটার শ্রমিক চারজন, কৃষিশ্রমিক পাঁচজন, রাজমিস্ত্রি একজন, টোলআদায়কারী একজন, ফুটপাতের হকার একজন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী চারজন, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি একজন, ইউপি চেয়ারম্যান একজনসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১১ জন এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৭২ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।

সম্প্রতি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। ফলে উচ্চগতির বাইক আমদানির সিদ্ধান্তের বিষয়টি প্রশ্নের মুখে পড়ছে

সুপারিশ

দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করা, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করা, পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা এবং গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা।

এছাড়া রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এবং সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি।

এমআই/এমএআর/