স্বজন হারাদের কান্নায় ভারী উঠেছে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার পরিবেশ

স্বজন হারাদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার পরিবেশ। কান্নার রোল পড়েছে গ্রামে গ্রামে। চলছে সন্তান হারা মায়ের আহাজারি। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন মাকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ পিতৃহীন ছেলেও। পীরগঞ্জের চার ইউনিয়নে চলছে শোকের মাতম।  

শুক্রবার (২৬ মার্চ) দুপুর পৌনে ২টার দিকে রাজশাহীর কাটাখালীতে হানিফ পরিবহনের বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসর মুখোমুখি সংঘর্ষে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুনে পুড়ে পীরগঞ্জ উপজেলার ১৭ জন নিহত হয়েছেন। তারা পীরগঞ্জ থেকে মাইক্রোবাসে করে রাজশাহীতে ঘুরতে যাচ্ছিলেন। 

রাজশাহী মহানগর পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের বরাত দিয়ে পীরগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরেস চন্দ্র ঢাকা পোস্টকে জানান, দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাস থেকে ১১ যাত্রীর পোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও দগ্ধ ছয়জনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে তাদের মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। 

পীরগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে এসেছে

মাইক্রোবাস থেকে উদ্ধার ১১ মরদেহের কাউকে চেনা যাচ্ছে না। তবে এর মধ্যে পাঁচজন পুরুষ, চারজন নারী এবং দুজন শিশু বলে শনাক্ত করেছে পুলিশ। অন্যদিকে রামেক হাসপাতালে মারা যাওয়া ছয়জনের মধ্যে দুজন পুরুষ, দুজন নারী ও দুই শিশু। তবে মাইক্রোবাসে থাকা সবার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান পীরগঞ্জ থানার ওসি সরেস চন্দ্র।

নিহতরা হলেন- পীরগঞ্জের চৈত্রকোল ইউনিয়নের বড় রাজারামপুর গ্রামের ব্যবসায়ী সালাহউদ্দিন (৩৬), তার স্ত্রী সামছুন্নাহার (২৮), ছেলে সাজিদ (৭), মেয়ে সাফা (৪), সামছুন্নাহারের বড় বোন কামরুন্নাহার (৪১), রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় মজিদপুর গ্রামের পার্টস ব্যবসায়ী ফুল মিয়া (৪০), তার স্ত্রী নাজমা (৩৫), মেয়ে সাবিয়া (৪), মেয়ে সুমাইয়া (৮), ছেলে ফয়সাল (১৩), রায়পুর ইউনিয়নের দ্বাড়িকাপাড়া গ্রামের মোখলেছার (৪৫), তার স্ত্রী পারভীন (৩৫), ছেলে পাভেল (১৯), মিঠিপুর ইউনিয়নের দূরামিঠিপুর দক্ষিণপাড়ার শহিদুল মিয়া (৪৫), পৌরসভার প্রজাপাড়ার তাজুল করিম ভুট্টু (৪৫), তার স্ত্রী মুক্তা বেগম (৩৫) ও ছেলে ইয়াসিন (১৪)। 

ওসি জানান, রাজশাহী থেকে ছেড়ে যাচ্ছিল হানিফ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস। কাটাখালী এলাকায় মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দেয় বাসটি। এতে মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ  হয়ে আগুন লেগে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। 

এদিকে দুর্ঘটনার খবর জানাজানি হওয়ার পর থেকে পীরগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নিহতের স্বজনেরা মরদেহ গ্রহণ করতে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। 

পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে স্বজনদের আহাজারি

বড়রাজা রামপুর গ্রামের নিহত সালাহউদ্দিনের চাচাতো ভাই নুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুক্রবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে স্ত্রী-তিন সন্তান ও বড় শ্যালিকাকে সঙ্গে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে রাজশাহীতে ঘুরতে যান সালাহউদ্দিন। ওই মাইক্রোবাসে আরও ১৩ জন যাত্রী ছিল। তারা সবাই পীরগঞ্জের বাসিন্দা।

তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনায় নিহতদের মরদেহ গ্রহণে তাদের পরিবারের তিনজন ইতোমধ্যে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। মরদেহ শনাক্ত করে নিয়ে আসার পর দাফনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অন্যদিকে বড় মজিদপুরে নিহত পার্টস ব্যবসায়ী ফুল মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের উপার্জনক্ষম ফুল মিয়াকে অকালে হারিয়ে শোকে কাতর হয়ে পড়েছে পুরো পরিবার। ফুল মিয়ার বৃদ্ধা মা সাহিদা খাতুনসহ পরিবারের লোকজনদের আহাজারিতে কান্না করছে গ্রামের সাধারণ মানুষরাও।

ফুল মিয়ার ছোট ভাই সুজন মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো দিনও ভাবি নাই একসঙ্গে পাঁচজনকে হারাবো। ভাই, ভাবি, ভাতিজা, ভাতিজি সবাই আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল। বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে আমাদের পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কেউ থাকলো না। আগে বাবাকে হারিয়েছি। আজ ভাইকে হারিয়ে যেন সব কিছুই হারালাম।

রামনাথপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মাহফুজার রহমান মাফু ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাইক্রোবাসে থাকা সবার মৃত্যু হয়েছে বলে শুনেছি। তবে আমার ইউনিয়নের বড় মজিদপুরের একই পরিবারের পাঁচজন মারা গেছেন। তাদের মরদেহ আনতে আমি রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর