হাসপাতালে সিট না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সে বাবার হাত ধরে বসে আছে ছেলে/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

মো. আমিরুল ইসলাম (৫২) এসেছেন নরসিংদীর মনোহরদী থেকে। থার্ম্যাক্স টেক্সটাইল মিলের বড় কর্মকর্তা তিনি। করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হন বেশ কিছু দিন আগে। শুক্রবার (৯ এপ্রিল) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) করোনা ইউনিটে ভর্তি হন তিনি।

তিনদিনের মাথায়ও ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) শয্যা ফাঁকা পাননি তিনি। ফলে সোমবার (১২ এপ্রিল) বাধ্য হয়েই হাসপাতাল ছাড়ছেন তিনি। কিন্তু কোথায় নেওয়া হচ্ছে তাকে? জানেন না আমিরুলের স্ত্রী। এখন পালা ভাগ্যকে সঙ্গী করে হাসপাতালের দরজা থেকে দরজায় ছুটে চলার। যেখানে আইসিইউ পাওয়া যাবে সেখানেই ভর্তি করা হবে তাকে। 

সোমবার (১২ এপ্রিল) সরেজমিনে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে ঢামেকে দেখা গেছে করোনা ইউনিটে ভর্তির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে অপেক্ষা করছেন রোগীরা। সিট খালি নেই, তবু অপেক্ষা যদি একটা সিট মেলে।

৩ দিন ভর্তি থাকার পর আইসিইউ না পেয়ে চলে যাচ্ছেন আমিরুল/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢামেক করোনা ইউনিটে ওয়ার্ড, সিসিইউ, এইচডিইউ ও কেবিন মিলিয়ে ৫৯৩টি বেড আছে। আইসিইউ আছে মাত্র ২০টি। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হিমসিম খেতে হচ্ছে।  হাসপাতাল থেকে রোগী যত না রিলিজ পাচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি চিকিৎসা নিতে আসছেন।

কথা হয় ভর্তি থাকার পর আইসিইউ না মেলা আমিরুল ইসলামের স্ত্রী ইয়াসমিন বেগমের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার স্বামীর করোনা ধরা পড়ে কয়েকদিন হলো। অবস্থা খারাপ হলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। ভর্তি হই এখানে। ৩ দিন থাকার পরে অবস্থা খারাপ হলে এখানে আইসিইউ না পাওয়ায় অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। তবে কোথায় যেয়ে আইসিইউ পাব তার কোনো ঠিক নাই।

হাতিরপুল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ঢামেকের করোনা ভবনের সামনে এসেছেন আব্দুর রহিম চৌধুরী। তার অক্সিজেন লেভেল অনেক নিচে নেমে গেছে। তাই তাকে তার ছেলে-মেয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কিন্তু এলে কী হবে? সিট খালি নেই। বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে রেখে মেয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন। বাবার হাত ধরে অ্যাম্বুলেন্সে বসে আছেন ছেলে। ১ ঘণ্টা পরে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে তাকে ভর্তির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

জানতে চাইলে আব্দুর রহিম চৌধুরীর ছেলে রাহুল বলেন, আমার বাবার বয়স ৬৯ বছর। ৪ দিন ধরে করোনা পজিটিভ অবস্থায় বাসায় ছিলেন। আজ (সোমবার) শরীর অনেক খারাপ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তাই দ্রুত এখানে নিয়ে এলাম। কিন্তু আনার পর শুনি সিট নাই। ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে অনুমতি পেলাম ভেতরে নিয়ে যাওয়ার। কী হবে এখনও জানি না।

মগবাজার থেকে করোনা আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে এসেছেন জেসমিন সুলতানা। তার ছেলে জুনায়েদ রাইয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা রফিকুল ইসলাম গত ২ সপ্তাহ ধরে একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এরপর আমার মা করোনায় আক্রান্ত হয়। গত ৮-১০ দিন মায়ের শরীরও খারাপ যাচ্ছে। আজ শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। আনার পরে সিট পাইনি, মাকে অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন দিয়ে রেখেছি। দেড় ঘণ্টা পরে একটি সিটের ব্যবস্থা হয়। আমরা খুব বিপদে আছি ভাই। একদিকে বাবা আইসিইউতে আর অন্য দিকে মায়ের এখন এই অবস্থা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডাক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে যে পরিমাণ সিট আছে তার চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি রোগী এলে কীভাবে চিকিৎসা দেবো বলেন? আমরা হিমসিম খাচ্ছি চিকিৎসা দিতে। কিন্তু অনেকে ভাবে সিট থাকতেও দেওয়া হয় না। আমরা অতিরিক্ত কিছু বেড দিয়ে তাদের চিকিৎসা করছি। খালি হলে নতুন আরেকজনকে দিচ্ছি। এখানে আমাদের এর চেয়ে বেশি কিছু করার থাকে না। আপনি যদি আমার জায়গায় থাকতেন তাহলে কত রকমের কথা শুনতে হয় বুঝতে পারতেন।

সিট পাওয়ার অপেক্ষায় অ্যাম্বুলেন্সে জেসমিন সুলতানার অপেক্ষা/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে থাকা ১২৯টি আইসিইউ’র মধ্যে রোববার (১১ এপ্রিল) বিকেল পর্যন্ত মাত্র ৩টি খালি ছিল। একটি মুগদা মেডিকেলে আর দুটি রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে। প্রাইভেট হাসপাতালে ৩৭৭টি আইসিইউ’র মধ্যে খালি রয়েছে মাত্র ৭টি।

বেড নেই হাসপাতালে
ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি হওয়ার মতো কোনো বেড খালি নেই। সরকারি হাসপাতালের করোনা ইউনিটের মধ্যে ২৮০০ বেডের মধ্যে মাত্র ৩০০টি বেড খালি রয়েছে। তবে সেগুলো বিশেষায়িত রোগীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে।

ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জে. নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা আক্রান্তদের জন্য ঢাকা মেডিকেলের নতুন ও পুরাতন বার্ন ইউনিট ভবনে মোট ৮০০টি বেড রয়েছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) আছে ২০টি এবং হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) আছে ৪০টি। আইসিইউ এবং এইচডিইউতে কোনো সিট খালি নেই। করোনা ইউনিটে গাইনি এবং সার্জারি বিভাগে কিছু সিট খালি আছে, তবে সেগুলোতে অন্য করোনা রোগী ভর্তি করা হয় না। কারণ হঠাৎ করে গর্ভবতী করোনা রোগী বা সার্জারির রোগী এলে তাদের সেখানে ভর্তি রাখা হয়।

দেশের করোনা পরিস্থিতি
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা দেশে ভাইরাসটিতে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এই নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮২২ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ২০১ জন। এতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৫৭ জন। সোমবার (১২ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

এসএএ/এইচকে