অর্থায়ন-তদারকির তাগিদ
বাংলাদেশের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিরাপদ-নির্ভরযোগ্য : গবেষণা
বাংলাদেশে সম্প্রতি নীতিগত পরিবর্তনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির চেয়ে পরিচ্ছন্ন জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান পরিসরে দেশের জন্য সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং জৈব শক্তিসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানিই নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি।
তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন হাইড্রোজেন, এমোনিয়া, পারমাণবিক শক্তির মতো পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎস এখনও অপ্রমাণিত, অবিশ্বাসযোগ্য এবং ব্যয়বহুল। প্রমাণিত নবায়নযোগ্য জ্বালানির চেয়ে পরিচ্ছন্ন জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে জ্বালানি নিরাপত্তা, সুরক্ষা, সাশ্রয়তা এবং জ্বালানি দুষ্প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপরে অভূতপূর্ব চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এই নীতিগত পরিবর্তনটি সাম্প্রতিক কপে বাংলাদেশের অবস্থানেরও বিপরীত।
বিজ্ঞাপন
চেঞ্জ ইনেশিয়েটিভ কর্তৃক ''ফলো দ্যা রিনিউয়েবল এনার্জি ফাইনান্স'' শীর্ষক নতুন প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল দেখায় যে- নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আরও বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ক্ষেত্রে আরও প্রতিযোগিতামূলক এবং ট্যারিফ নির্ধারণে স্বচ্ছতা দেখাতে হবে।
বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) চেঞ্জ ইনেশিয়েটিভ মহাখালী ডিওএইচএস এলাকায় নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ''ফলো দ্যা রিনিউয়েবল এনার্জি ফাইন্যান্স'' শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এটি বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বর্তমান অবস্থা, অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ এবং ২০২৩ সাল পর্যন্ত গৃহীত পদ্ধতি সম্পর্কে একটি দ্বিবার্ষিক প্রতিবেদন। এই গবেষণা প্রতিবেদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সংযোজন ও গতিবিধির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবেদনে বলা হয়, মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা (এমসিপি) অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গবেষণাটি প্রকাশের সময় পর্যন্ত, বাংলাদেশ সৌরশক্তি থেকে ৪৬১ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করেছে এবং আরও ৪১১৫ মেগাওয়াট প্রকল্প পরিকল্পনার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
চেঞ্জ ইনেশিয়েটিভের গবেষণায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রায় অসঙ্গতি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প অনুমোদনের অনিয়ম এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে অতিরিক্ত ট্যারিফ উঠে এসেছে। সামগ্রিক ক্ষমতার ৪৪.৩৪ শতাংশ (২০২০.৩০ মেগাওয়াট) সৌর প্রকল্প চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত, যেটি সবচেয়ে বেশি সৌর বিকিরণের এলাকা; রংপুরে ১৮ শতাংশ সৌর প্রকল্প (৬১১.৩ মেগাওয়াট) এবং ময়মনসিংহে ১৩ শতাংশ সৌর প্রকল্প (৫৫১.৭ মেগাওয়াট) রয়েছে।
কপ-২৮ সম্মেলনে, বাংলাদেশসহ ১২৩টি দেশের নেতারা "গ্লোবাল রিনিউয়েবলস অ্যান্ড এনার্জি ইফিসিয়েন্সি প্লেজ" নামে একটি চুক্তিতে সম্মত হন, যার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তির লক্ষ্যমাত্রা তিনগুণ বাড়ানো এবং শক্তির কার্যকারিতা উন্নয়নের হার দ্বিগুণ করে ৪ শতাংশের বেশি করার একটি সম্মিলিত লক্ষ্যে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে।
প্রতিবেদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের মালিকানা, অর্থায়ন, ট্যারিফ এবং বাস্তবায়নের ব্যাপারেও আলোকপাত করা হয়। এতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা, ক্রয়ের স্বচ্ছতা এবং মূল্যায়ন কৌশলের তারতম্য দেখানো হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিকল্পিত প্রকল্পের ৫৯ শতাংশ বেসরকারি মালিকানাধীন খাত যেখানে মোট তহবিলের ৬২ শতাংশ বিনিয়োগ করে।
প্রতিবেদনে সরকারি এবং বেসরকারি ট্যারিফের পার্থক্যের বিষয়টিও উঠে এসেছে। বেসরকারি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলি বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য ১৩ সেন্ট/ কিলোওয়াট ঘণ্টা ট্যারিফ আদায় করছে। বিপরীতে সরকারি প্রকল্পগুলোর ট্যারিফ হার গড়ে ১০ সেন্ট/ কিলোওয়াট ঘণ্টা প্রদান করে। এ ছাড়া, যৌথ উদ্যোগ প্রকল্পগুলো সরকারি প্রকল্পগুলোর তুলনায় উচ্চ ট্যারিফ আদায় করছে।
বিভিন্ন ধারণ ক্ষমতার পরিসরে ট্যারিফের হারে কোনো স্পষ্ট প্রবণতা নেই, যা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মূল্য নির্ধারণ কৌশলে ধারাবাহিকতা চিহ্নিত করা কঠিন করে তোলে। বেশিরভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পই টেন্ডার প্রক্রিয়ার বাইরে, যা এখানে প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি নির্দেশ করে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য ট্যারিফের হার বিভিন্ন মালিক এবং ধারণ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়, বেসরকারি প্রকল্পগুলো সরকারি এবং যৌথ উদ্যোগ প্রকল্পগুলোর চেয়ে উচ্চ হার আদায় করে।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন নির্ধারকের উপর ভিত্তি করে ট্যারিফ হার নির্ধারণ করে এবং বিভিন্ন প্রকল্পের বিস্তারিত ব্যয় অনুমান এবং ট্যারিফের হার প্রকাশ করে। বাংলাদেশে এখনও এই ধরনের স্বচ্ছতা নেই এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এই ধরনের তথ্যও প্রকাশ করে না।
এ প্রসঙ্গে জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ এবং চেঞ্জ ইনেশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম জাকির হোসেন খান বলেন, জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের টেকসই অগ্রগতি নির্ভর করছে প্রকৃতিনির্ভর, সাশ্রয়ী এবং সার্বভৌম নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক অর্থনীতি গড়ার মাধ্যমে। কোনো অবস্থাতেই দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহল যেন এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের এখতিয়ার খর্ব করে অযৌক্তিক ট্যারিফের মাধ্যমে অনৈতিক ফায়দা লুটতে না পারে।
তিনি বলেন, বিদ্যমান জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে হলে অবশ্যই জ্বালানি খাতে শুদ্ধাচার ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করতে হলে অবশ্যই স্মার্ট তথা সবুজ জ্বালানি নির্ভর সবুজ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে।
চেঞ্জ ইনেশিয়েটিভের সুপারিশ
১. উচ্চ সৌর বিকিরণ এবং বাতাসের গতিসম্পন্ন অঞ্চলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা কাজে লাগানো;
২. নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্প্রসারণের জন্য প্রাপ্ত অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা;
৩. প্রতিযোগিতামূলক প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে, ঋণের উপর নির্ভরতা কমিয়ে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে অনুদান এবং সুবিধাজনক তহবিলের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা;
৪. ঝুঁকি ও ঋণ ফেরতের সক্ষমতা বাড়াতে এবং অর্থায়ন চাহিদা মেটানোর জন্য কার্বন ট্যাক্স এবং অনুরূপ উদ্ভাবনী আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণ;
৫. নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের মূল্যায়ন এবং মানচিত্র তৈরি করা, পাশাপাশি একটি বিস্তৃত নবায়নযোগ্য জ্বালানি অর্থায়ন কৌশল গ্রহণ করা;
৬. নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলোর জন্য ট্যারিফ নির্ধারণ প্রক্রিয়া আরও উন্নত করতে স্বচ্ছ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতি গ্রহণ করা, যেখানে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক উদাহরণ অনুসরণ করা হবে।
৭. পরিবেশগত এবং সামাজিক মানদণ্ডগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে অবশ্যই নবায়নযোগ্য জ্বালানি সিদ্ধান্তের জন্য একটি শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সৌরশক্তিভিত্তিক সেচ ব্যবস্থাসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের সমস্ত পর্যায়ে সম্মতি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
৮. নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে নাগরিক সমাজ, বেসরকারি খাত, একাডেমিয়া এবং মিডিয়ার সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়ে নীতিমালা উন্নয়ন, বাস্তবায়ন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের তদারকি করতে হবে।
জেইউ/এমজে