দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতীক পাওয়ার পর থেকে নৌকার প্রার্থীরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন। তবে কোনো কোনো আসনে নৌকার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন হেভিওয়েট আওয়ামী নেতা। এ আসনগুলোতে দিন গড়ানোর সঙ্গে নৌকার প্রার্থীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। প্রচার-প্রচারণার মাঝামাঝি সময়ে এসে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রার্থীদের। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাসও মিলছে আসনগুলোতে।

চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা মিলিয়ে আসন রয়েছে ১৬টি। এরমধ্যে অন্তত ৮টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রতীকের প্রার্থীরা। এসব আসনগুলোতে দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরা দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। কোনো কোনো আসনে উল্টো স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণের পাল্লা ভারী রয়েছে। এতে করে এসব আসনগুলোতে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নৌকার প্রার্থীরা বেশ বিপাকে পড়েছেন।

স্থানীয় লোকজন ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-১, ২, ৩, ১০, ১১, ১২, ১৫ ও ১৬সহ মোট ৮টি আসনে হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। এসব আসনগুলোতে প্রচার-প্রচারণায় প্রতিদিনই সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বেপরোয়া মনোভাবে বিভিন্ন প্রার্থীরা লঙ্ঘন করছেন আচরণবিধি। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন থানায় রুজু হচ্ছে মামলা। একই সঙ্গে রিটার্নিং কার্যালয়ে জমা হচ্ছে অভিযোগ। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা বিচারকরা শোকজ করছেন প্রার্থীদের। 

এদিকে, চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ আসনগুলোতে নিরপত্তায় বিশেষ ছক এঁকেছে জেলা পুলিশ। আসনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা এবং নির্বাচনের সহিংসতা দমনে একজন করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম-১ আসনে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) কবীর আহম্মেদ, চট্টগ্রাম-৩ আসনে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) এ. এন. এম ওয়াসিম ফিরোজ, চট্টগ্রাম-১২ আসনে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন, চট্টগ্রাম-১৫ আসনে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) আসাদুজ্জামান ও চট্টগ্রাম-১৬ আসনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি ও শিল্পাঞ্চল) সুদীপ্ত সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম-২ আসনে এখনো কাউকে আলাদাভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

এছাড়া চট্টগ্রাম-১০ ও ১১ আসন দুটি পড়েছে চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায়। এখানে এখনো মেট্রোপলিটন পুলিশ বিশেষভাবে কাউকে দায়িত্ব দেয়নি। তবে নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নজরদারি করছেন।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান বলেন, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কিছু ক্ষেত্রে আচরণবিধি মেনে চলছেন না। দুয়েকটি জায়গায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। সেসব বিষয়ে প্রার্থীরা আমাদের অভিযোগ করেছেন। প্রত্যেকটি অভিযোগের সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে আমরা তাদের জানিয়েছি। থানা মামলা নিয়েছে। অভিযুক্তদের আটক করা হয়েছে। আমরা নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।

তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে আমরা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য এবং বৈধ অস্ত্র অবৈধ ব্যবহার বন্ধ করতে সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করব। যে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে সেগুলোকে কেন্দ্র করে আমাদের অভিযান পরিচালনা হবে।আপনারা জানেন যে, গত পরশু দিন সরকারের জননিরাপত্তা বিভাগ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যেখানে নিবার্চনের পরে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সকল ধরণের অস্ত্র প্রদর্শন এবং বহন করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে মোট প্রার্থী হয়েছেন ৭ জন। এর মধ্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছেন মাহবুর উর রহমান। তিনি দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে। আসনটিতে তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। তিনি ঈগল প্রতীক নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন ভোটের মাঠে। দলের দুই প্রার্থী একসঙ্গে ভোটে মাঠে থাকায় নেতাকর্মীরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। কেউ নিয়েছেন মাহবুব উর রহমানের পক্ষ এবং কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন মোহাম্মদ গিয়াসের পক্ষে।

চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে প্রার্থী হয়েছেন ৮ জন। এর মধ্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনয়নে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন খাদিজাতুল আনোয়ার সনি। আসনটিতে তরমুজ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হোসাইন মো. আবু তৈয়ব। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সামনে রেখে আসনটিতে এই দুই প্রার্থীর লড়াই চলছে। তবে কে জিতে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত।

চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে মোট প্রার্থী হয়েছেন ৮ জন। আসনটিতে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছেন মাহফুজুর রহমান। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে আসনটিতে মাঠে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরী। আওয়ামী লীগের এই নেতা ভোটের মাঠে শেষপর্যন্ত থাকলে ঘাম ঝরবে নৌকার প্রার্থী মিতার। 

চট্টগ্রাম-১০ (চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৮, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ২৪, ২৫ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড) আসনে মোট প্রার্থী হয়েছেন ৯ জন। আসনটিতে আওয়ামী লীগ মনোনয়নে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু। এখান থেকে ফুলকপি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মোহাম্মদ মনজুর আলম। তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ছিলেন। দুই হেভিওয়েট প্রার্থী মাঠে থাকায় হিসেব-নিকেশ জটিলই থেকে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম-১১ (চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪১ ওয়ার্ড) আসনে মোট প্রার্থী হয়েছে ৭ জন। আসনটিতে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছেন এম. আবদুল লতিফ। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন নির্বাচন করছেন কেটলি মার্কা নিয়ে। তার পক্ষ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের নেতারা। ইতোমধ্যে তিনি ঘুরছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে, দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। বসে নেই নৌকার প্রার্থী আবদুল লতিফও। তিনিও নৌকা জেতাতে লড়ে যাচ্ছেন।

চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে মোট প্রার্থী হয়েছেন ৮ জন। আসনটি আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছেন মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরী হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। তিনি আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য ও হুইপ। দুই প্রার্থীই নির্বাচনের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সমানতালে। কেউ কেউ কাকে ছাড় দিতে নারাজ।

চট্টগ্রাম-১৫ (আংশিক সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া) আসনে মোট প্রার্থী হয়েছেন ৭ জন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছেন আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মোতালেব পেয়েছেন ঈগল। তিনি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। চট্টগ্রামের আসনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে এখানেই। ইতোমধ্যে তার আভাসও মিলছে। প্রতিনিয়ত নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে। দুই প্রার্থীই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করেছে।

চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে মোট প্রার্থী হয়েছেন ১০ জন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও শিল্পপতি। আসনটিতে এই দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল ৩০ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই হয়েছে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিল ১৭ ডিসেম্বর। এরপর ১৮ জানুয়ারি প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। 

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করতে হয়। চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। এর আগের ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা আছে।

এমআর/এমএসএ