চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শহীদ মিনার সংলগ্ন এলাকায় বন্ধুসহ ছাত্রী হেনস্তা ও ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। গত ২৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবরে এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতে ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করে নানা পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ উল্লেখ করেছে কমিটি।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চবি ক্যাম্পাস পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। এ কারণে গভীর রাতে ছাত্রীদের হলের বাইরে থাকায় বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগী ছাত্রী ও তার বাগদত্তা ঘটনার দিন গভীর রাতে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় বিচরণ করেন। একপর্যায়ে তারা হেনস্তা ও ছিনতাইয়ের শিকার হন। আবার ঘটনার পর ভুক্তভোগীরা পুলিশ, হলের প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষক কিংবা প্রক্টরিয়াল বডির সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করেননি। এতে অপরাধীরা দ্রুত সটকে পড়ে এবং তারা মুখোশধারী হওয়ায় শনাক্ত করতে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে।

তদন্ত কমিটির ধারণা, ঘটনায় জড়িত দুজনই চবির ছাত্র। কমিটি তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়েরের পরামর্শ দিয়েছে। একইসঙ্গে জরুরি প্রয়োজনে রাত ১০টা থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীদের প্রবেশ এবং হল থেকে বের হওয়ার সময় গেটে রেজিস্টার খাতায় তথ্য সংরক্ষণ করতে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

এদিকে, তদন্ত কমিটির সুপারিশের পর মামলা দায়ের করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমেদের জমা দেওয়া এজাহারের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে হাটহাজারী থানায় মামলা করা হয়। এতে অজ্ঞাতনামা দুজনকে আসামি করা হয়। তবে এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার কিংবা শনাক্ত করতে পারেনি। তবে আসামিদের গ্রেপ্তার ও ভুক্তভোগীদের খোয়া যাওয়া তিনটি মোবাইল ও মালামাল উদ্ধার করতে চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।

জানা গেছে, গত ২৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে চবি ক্যাম্পাসে হেনস্তা ও ছিনতাইয়ের শিকার হন পদার্থবিদ্যা বিভাগের ২০১৭-২০১৮ সেশনের শিক্ষার্থী রহিমা নাজনীন জ্বীম। ওইসময় তার সঙ্গে ছিলেন বাগদত্তা নাজিম উদ্দিন আরেফিন (৩০)। তিনি চবির ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন বলে জানা গেছে।

তদন্ত কমিটির ধারণা, ঘটনায় জড়িত দুজনই চবির ছাত্র। কমিটি তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়েরের পরামর্শ দিয়েছে। একইসঙ্গে জরুরি প্রয়োজনে রাত ১০টা থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীদের প্রবেশ এবং হল থেকে বের হওয়ার সময় গেটে রেজিস্টার খাতায় তথ্য সংরক্ষণ করতে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ছাত্রী জ্বীম ২৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবরে অভিযোগ জমা দেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুরকে আহ্বায়ক এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়া হলের প্রভোস্ট ড. নাজনীন নাহার ইসলাম ও দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. নাজেমুল আলমকে সদস্য করে কমিটি গঠন করে প্রশাসন। ওই কমিটি ২৭ ডিসেম্বর উপাচার্য বরাবরে প্রতিবেদন দাখিল করে।

প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়, তদন্ত কমিটি ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর দুটি সভায় মিলিত হয়। একই সঙ্গে কমিটি ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তি, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার বাগদত্তা নাজিমুদ্দিন আরেফিন, ভুক্তভোগী ছাত্রীর মা নূরুন নাহার বেগম, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। কমিটি ঘটনার কাছাকাছি সময়ে ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার সংরক্ষিত ভিডিও ফুটেজ যাচাই-বাছাই করে।

ঘটনার বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জ্বীম তদন্ত কমিটিকে জানান, ঘটনার দিন তার বাগদত্তা আরেফিন তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ওইদিন রাতের খাবার খেয়ে জ্বীম প্রীতিলতা হল থেকে বেরিয়ে রাত ১০টার দিকে বাগদত্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করেন। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে জ্বীম ও আরেফিন একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জিরো পয়েন্ট ক্রস করে রেলস্টেশন এলাকায় একটি ঝুপড়িতে বসে চা-নাস্তা খান এবং আড্ডা দেন। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে তারা কাটাপাহাড় ক্রস করে শহীদ মিনারের পাশে জারুল বাগানের ঝুপড়িতে জসিমের দোকানের সামনে বসে ব্যক্তিগত বিষয়ে আলাপরত ছিলেন।

রাত আনুমানিক ৩টা ২৫ মিনিটের দিকে হঠাৎ ওই দোকানের পাশে দুপাশ থেকে মাফলার দিয়ে মুখ ঢাকা দুজন তাদের ঘিরে ধরে। এসময় অভিযুক্তরা তাদের সঙ্গে অশ্লীল ভাষায় বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। একপর্যায়ে অভিযুক্তরা জ্বীম ও আরেফিনকে শারীরিকভাবে নাজেহাল এবং তাদের তিনটি মোবাইল ও একটি পার্টস নিয়ে দ্রুত দৌড়ে দোকানের পেছনের দিকে পাহাড়ে চলে যায়। ভুক্তভোগীরা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। এরপর তারা পুলিশের সহায়তার জন্য ক্যাম্পাসের স্মরণ চত্বরের দিকে রওনা হন এবং সেখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তা প্রহরীকে বিষয়টি অবহিত করেন।

প্রহরী তাদের নিকটস্থ পুলিশ বক্সে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা পুলিশকে অবহিত না করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত তাদের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এতে তারা ঘটনায় কোনো প্রতিকার পাননি। ঘটনার পরদিন ২৫ ডিসেম্বর দুপুরে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী প্রক্টর অফিসে অভিযোগ দাখিল করেন এবং এ ঘটনায় ওই দিন সন্ধ্যায় হাটহাজারী থানায় একটি জিডি করা হয়।

তদন্তকালে ঘটনার বিষয়ে চবি প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার এবং তার সহকারী প্রক্টরদের সঙ্গে কথা বলে কমিটি। কমিটিকে তারা জানান, ঘটনার পরপরই ভুক্তভোগীদের উচিত ছিল তাদের অবহিত করা। অন্ততপক্ষে ঘটনাস্থলের পাশে উপাচার্য বাংলো অথবা ব্যবসা প্রশাসন অনুষদ ভবনের দায়িত্বে থাকা প্রহরীদের সহায়তা নেওয়া উচিত ছিল। এতে ঘটনায় জড়িতদের পাকড়াও করা সহজ হতো। কিন্তু তারা তা না করে অপেক্ষাকৃত দূরে ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্ট এলাকায় চলে যান। পরদিন তারা দুপুর ১টার দিকে প্রক্টরের অফিসে যোগাযোগ করে অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর অভিযোগটি যথাযথ ব্যবস্থার জন্য রেজিস্টার বরাবর প্রেরণ করে প্রক্টরিয়াল বডি।

সার্বিক তদন্ত শেষে তদন্ত কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে, চবি ক্যাম্পাস দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। ফলে রাতের অন্ধকারে এখানে যেকোনো অপরাধ সংঘটিত করে অপরাধীরা সহজে পালিয়ে যেতে পারে। নিরাপত্তাজনিত কারণে চবি ক্যাম্পাসে রাতে আবাসিক হলের বাইরে শিক্ষার্থীদের অবস্থান না করা নির্দেশনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও জ্বীম ও আরেফিন রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত আবাসিক হলের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশন এলাকায় ঝুপড়ি এবং শহীদ মিনারের পাশের ঝুপড়িতে অবস্থান করেন। ফলে অপরাধীরা এ ঘটনার সুযোগ গ্রহণ করে এবং ঘটনা ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে কেটে পড়ে।

পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করা হয়, মধ্যরাতে ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরেও ভুক্তভোগীরা নিকটস্থ দায়িত্বরত নিরাপত্তা প্রহরীর শরণাপন্ন হননি। উপরন্তু তারা যখন অপেক্ষাকৃত দূরে স্মরণ চত্বরের নিরাপত্তা প্রহরীকে বিষয়টি অবহিত করেন তখন আনুমানিক ভোর সাড়ে ৪টা এবং ওইসময়ের মধ্যে অপরাধীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা তৎক্ষণাৎ প্রীতিলতা হলের প্রভোস্ট কিংবা আবাসিক শিক্ষক, প্রক্টরিয়াল বডি কিংবা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ বা সহায়তা গ্রহণ করেননি। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তদন্ত কমিটি ধারণা করছে অভিযুক্ত দুজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী হতে পারে। কিন্তু কমিটির তাদের শনাক্ত করতে পারেনি।

তদন্ত কমিটি তাদের সুপারিশে উল্লেখ করে, চবি ক্যাম্পাস পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় ছাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় রাতে আবাসিক হলের বাইরের অবস্থান না করার বিধিনিষেধ রয়েছে। তা সত্ত্বেও কিছু ছাত্রী গভীর রাতে হলের বাইরে অবস্থান করছে এবং বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটির তিনটি সুপারিশ হলো– রাতের শেষ শাটল ট্রেন ক্যাম্পাসে পৌঁছার পর অর্থাৎ রাত ১০টা থেকে ছাত্রীদের হলগুলোতে আবাসিক শিক্ষার্থীদের প্রবেশ এবং হল থেকে বের হওয়ার সময় গেটে রেজিস্টার খাতায় তথ্য সংরক্ষণ করা। সবশেষ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করা এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারাদেশসহ প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের হাটহাজারী থানায় মামলা করার পরামর্শ দেয় তদন্ত কমিটি।

তদন্ত কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে, চবি ক্যাম্পাস দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। ফলে রাতের অন্ধকারে এখানে যেকোনো অপরাধ সংঘটিত করে অপরাধীরা সহজে পালিয়ে যেতে পারে। নিরাপত্তাজনিত কারণে চবি ক্যাম্পাসে রাতে আবাসিক হলের বাইরে শিক্ষার্থীদের অবস্থান না করা নির্দেশনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও জ্বীম ও আরেফিন রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত আবাসিক হলের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশন এলাকায় ঝুপড়ি এবং শহীদ মিনারের পাশের ঝুপড়িতে অবস্থান করেন। ফলে অপরাধীরা এ ঘটনার সুযোগ গ্রহণ করে এবং ঘটনা ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে কেটে পড়ে

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রপতি মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার দিন রাতে বাগদত্তা ওই ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চবি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। ওইদিন তারা ক্যাম্পাসে গভীর রাতে বিভিন্ন এলাকায় বিচরণ করেছিলেন। কিন্তু পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় চবিতে রাতে ছাত্রীদের এভাবে বিচরণে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু তারা দুজনেই কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো ঘোরাঘুরি করেছেন। ঘটনার সময় মধ্যরাতের পর এবং ভোরের আগে। এসময়ে ক্যাম্পাসের লোকজন সাধারণত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন। এ সুযোগে পাহাড় থেকে নেমে দুই মুখোশধারী ব্যক্তি ভুক্তভোগী দুজনকে হেনস্তা করে এবং মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়।

তিনি বলেন, ঘটনার বিষয়ে ভুক্তভোগীরা প্রথমে প্রশাসন ও পুলিশকে অবহিত করেননি। তারা ক্যাম্পাসের ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। যদিও পরে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবহিত করেন। তদন্ত কমিটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিষয়টি তুলে আনার চেষ্টা করেছে। আমরা ভুক্তভোগী ও প্রক্টরিয়াল বডির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলি। সবমিলিয়ে কিছু সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করেছি।

জানতে চাইলে হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছাত্রী ও এক ব্যক্তি হেনস্তার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। দুজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে এতে আসামি করা হয়েছে। তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

চবিতে ছাত্রী হেনস্তার ঘটনা আগেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে। গত বছর ১৭ জুলাই রাতে এক ছাত্রীকে বিবস্ত্র করার অভিযোগ ওঠে পাঁচ তরুণের বিরুদ্ধে। তার আগে শাটল ট্রেনেও বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে যৌন হেনস্তার অভিযোগ পাওয়া যায়।

এমআর/এসএসএইচ