প্রণোদনা-স্বাস্থ্যবিমার পরিবর্তে চিকিৎসকরা ‘অপমানিত’ হচ্ছেন
এফডিএসআরের অনলাইন সংবাদ সম্মেলন
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। শুরুতে তাদের প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা ও স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো চলমান বিধিনিষেধে চিকিৎসকদের হয়রানি ও অপমান করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোমবার (১৯ এপ্রিল) সন্ধ্যায় চলমান বিধিনিষেধে চিকিৎসকদের হয়রানির প্রতিবাদে আয়োজিত অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে নানা অভিযোগ উপস্থাপন করেন ‘ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেস্পন্সিবিলিটিজ’ সংক্ষেপে এফডিএসআর।
বিজ্ঞাপন
অনুষ্ঠানের শুরুতে লিখিত প্রতিবাদলিপি পাঠ করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সারা পৃথিবীতে যেখানে ডাক্তারদের বিশেষভাবে সম্মানিত করা হচ্ছে, সেখানে শুরু থেকে আমরা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েছি। শুরুতে নকল মাস্ক সরবরাহ করে আমাদের মৃত্যুর সামনে দাঁড় করানো হয়। একসময় কর্তব্যরত চিকিৎসকদের জন্য আবাসন ও যানবাহনের ব্যবস্থা করা হলেও তা আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, প্রণোদনা ও স্বাস্থ্যবিমার কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন বলতে কিছুই হয়নি। এমন প্রতিকূলতার মুখেও আমরা জীবনবাজি রেখে কোভিড রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এর বিনিময়ে সম্মান বা স্বীকৃতি তো দূরের কথা, পদে পদে অপমানিত হচ্ছি।
বিজ্ঞাপন
ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন বলেন, করোনাজনিত পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে দেশে কঠোর লকডাউন চলছে। এ সময় জরুরি সেবা দেওয়া পেশাজীবীরা ছাড়া অন্যদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সামনে থেকে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বাংলার চিকিৎসক সমাজ। অথচ আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, গত ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া লকডাউনের প্রথম দিনেই প্রচুর সংখ্যক চিকিৎসক ডিউটিতে যাবার পথে একাধিক স্থানে পুলিশের হেনস্তার শিকার হন। এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এফডিএসআরের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের পাশাপাশি আমরা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের হয়রানি বন্ধের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের পক্ষ থেকেও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করা হয়। এরপর এ ধরনের হয়রানির সংখ্যা কমলেও লকডাউনের পঞ্চম দিনে অর্থাৎ গতকাল রোববার আমরা দেখলাম, হাসপাতাল থেকে ডিউটি শেষে ফেরার পথে এলিফ্যান্ট রোডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনি একদল পুলিশ কর্তৃক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ইতোমধ্যে ওই ঘটনার আংশিক ধারণকৃত ভিডিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, একদল পুরুষ পুলিশ একজন মহিলা চিকিৎসককে প্রকাশ্য রাজপথে হেনস্তা করছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ডাক্তাররা যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্মুখ সারিতে লড়ছে, হাসপাতালে অসংখ্য কোভিড রোগীর চিকিৎসা শেষে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরার পথে পুলিশ ডা. সাঈদা শওকত জেনির গাড়ি থামিয়ে তার কাছে পরিচয়পত্র দেখতে চায়। এ সময় নিজের পরিচয় ও গাড়িতে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক কর্তৃক ইস্যুকৃত মুভমেন্ট পাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সম্বলিত স্টিকার ও বিএসএমএমইউর লোগোসহ ডাক্তারের নামাঙ্কিত অ্যাপ্রন দেখালে সবকিছুকে ভুয়া বলে পুলিশ ডা. জেনিকে চরমভাবে উত্ত্যক্ত করে। এর মাধ্যমে পুলিশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসক সমাজকেও হেয় করেছে। ওই ঘটনার কোনো ভিডিও করা হয়নি। অথচ ডা. জেনিকে হেনস্তা করার মাধ্যমে উত্তেজিত করে ঘটনার আংশিক ভিডিও করা হয়েছে যেখানে আমরা দেখেছি, পুলিশ ডা. জেনির কাছে অন্যায়ভাবে মুভমেন্ট পাস চেয়েছে। অথচ ডাক্তারদের মুভমেন্ট পাস লাগবে না বলে এর আগে নিশ্চিত করা হয়েছে।
এফডিএসআর চেয়ারম্যান বলেন, চিকিৎসকের পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী বীর বিক্রমের কন্যার পরিচয় দেবার পরও পুলিশ যে ভাষায় কথা বলেছে, আমরা তাতে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। পুলিশের ওই অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহসের সঙ্গে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আমরা ডা. সাঈদা শওকত জেনিকে অভিনন্দন জানাই। পাশাপাশি করোনার এ দুঃসময়ে চিকিৎসক হেনস্তাকারী পুলিশদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে, মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য রাজপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক মহিলা পুলিশ নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।
ওই ঘটনা সরকারকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র কি না- বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে, জানিয়ে এফডিএসআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার যখন করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তরিকতার সঙ্গে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যখন বারবার চিকিৎসক হয়রানি বন্ধের জন্য আমাদের আশ্বস্ত করছে, তখন মাঠপর্যায়ে চিকিৎসকদের প্রতি কতিপয় ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের হয়রানিমূলক আচরণে আমরা যুগপৎ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। এসব ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তার অতীত সম্পর্কে যেসব তথ্য ইতোমধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, তাতে আমরা রীতিমতো আতঙ্কিত বোধ করছি। তবে কি এসব ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশ সুকৌশলে ডাক্তার ও পুলিশ বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সরকারকেই বিপদে ফেলবার ষড়যন্ত্র করছে? এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা উচিত।
ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন বলেন, পথে পথে ডাক্তারদের আইডি কার্ড চেয়ে যেভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০ হাজারের মতো সরকারি এবং ৫০ হাজারের বেশি বেসরকারি ডাক্তার বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত। বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত অধিকাংশ ডাক্তারেরই প্রাতিষ্ঠানিক আইডি কার্ড নাই। আইডি কার্ড না থাকলেও প্রতিষ্ঠান থেকে ইস্যুকৃত ছবিসম্বলিত পাস বা চিঠি, এমনকি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) ওয়েবসাইটে গিয়ে যে কেউ রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে ডাক্তারের পরিচিতি শনাক্ত করতে পারে। লকডাউনে আইডি কার্ড বহনের গুরুত্ব কী? কোনো ব্যক্তি ডাক্তার কি না, সেটি নিশ্চিত করা নাকি কেবলমাত্র আইডি কার্ড সঙ্গে আছে কি না, সেটা চেক করা? ডাক্তারদের গাড়ি বা রিকশা থামিয়ে অন্যায়ভাবে জরিমানা করার হারও গত কয়েকদিনে বহুগুণ বেড়েছে। এভাবে চললে ডাক্তাররা তো ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাবে না। পাশাপাশি তাদের মনোবলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, প্রতিটি চিকিৎসকের যেমন ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক যানবাহনে আসা-যাওয়া করার সুযোগ নাই, আমরা চাই ডাক্তারদের কর্মস্থলে যাতায়াত সম্পূর্ণ নিরাপদ হোক। প্রয়োজনে বিআরটিসির অলস বসে থাকা বাসে ডাক্তারসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীকে যাতায়াতের সুযোগ দেওয়া হোক। করোনা ইউনিটে কর্তব্যরত সকল চিকিৎসকের আবাসন, যানবাহন ও বিশেষ ডিউটি রোস্টারের ব্যবস্থা করা হোক। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পথে ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্মান ও নিরাপত্তার সঙ্গে কাজ করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়া হোক।
করোনায় ১৮০ জন চিকিৎসকের প্রাণহানি হয়েছে জানিয়ে অনুষ্ঠানে বলা হয়, করোনার বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় পুরো বিশ্ব আজ যখন তটস্থ, তখন আমরা দেখছি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটছে। আপনারা জানেন, গত বছরের মার্চে শুরু হওয়া করোনা মহামারি মোকাবিলা করতে গিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রথম সারির করোনাযোদ্ধা চিকিৎসক, পুলিশসহ অনেকেই জীবন দিয়েছেন। আজ সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে আমরা করোনাযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী ১৮০ চিকিৎসকসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ বাহিনী এবং অন্যান্য পেশার সকলকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমরা প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহ তাদের বেহেশত নসিব করুক।
টিআই/এমএআর/