কবিতার বই বেশি, পাঠক কম : মান নিয়ে প্রশ্ন
অমর একুশে বইমেলার ইতিমধ্যেই ১৯ দিন পেরিয়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে মেলায় দর্শনার্থীদের পদচারণা বেড়েই চলছে। বইয়ের বিক্রিও বাড়ছে আনুপাতিক হারেই। দূরদূরান্ত থেকে পাঠকরা বইমেলায় আসছেন এবং নিজেদের পছন্দমতো বই কিনছেন।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এবারের বইমেলায় সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বই। তবে বিক্রিতে শীর্ষে উপন্যাস, থ্রিলার, গল্প, সায়েন্স ফিকশন ও অনুবাদধর্মী বই। কবিতার বইয়ের মান কমে যাওয়ায় পাঠকরা আগ্রহ হারাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
এবারের মেলায় সোমবার পর্যন্ত গল্প, নাটক, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, সায়েন্স ফিকশন, জীবনী, বিজ্ঞান, ভ্রমণ, ধর্ম, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য ক্যাটাগরিতে মোট ১ হাজার ৯৯৩টি নতুন বই এসেছে, যার মাঝে ৬১৯টি কবিতার বই। যা সংখ্যায় প্রায় ৩০ শতাংশ। তবে প্রকাশিত কবিতার বই সংখ্যায় বেশি হলেও বিক্রি তুলনামূলক কম।
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ দফতরের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে বইমেলায় মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৬ হাজারের অধিক। তারমধ্যে কবিতার বই এসেছে ৫ হাজার ১৯৭টি। এরমধ্যে ২০২৩ সালে ১২৪৭টি, ২০২২ সালে ১০৬০টি, ২০২১ সালে ৮৯৮টি এবং ২০২০ সালে ১৫৮৫টি কবিতার বই এসেছে।
বিজ্ঞাপন
এত শত কবিতার বই প্রকাশ হওয়ায় সেগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন করছেন অনেকেই। মান কমে যাওয়ায় বইয়ের বিক্রি অনেক কম বলে জানিয়েছেন পাঠক ও বিক্রয়কর্মীরা। তাছাড়া মানুষের চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে বলেও মনে করছেন পাঠক ও লেখকরা।
তরুণ কবি তানভীর রহমানের ফিলিস্তিনের আল আকসাকে নিয়ে লেখা কবিতার বই ‘হৃদয়ে কুদস’ পাওয়া যাচ্ছে ১২৮ নাম্বার স্টলে। তিনি বলেন, বর্তমানে মানসম্মত লেখকের বড়ই অভাব। একসময় খুব জনপ্রিয় ও ভালো মানের লেখা নিয়ে আসা কবিদের বর্তমানে বড় অভাব। বর্তমানে লেখকদের কবিতার বইগুলো এককেন্দ্রিক। এখন মানুষ কবিতা লেখে বৈরাগী হয়ে। মানুষ ভাবছে কবিতা মানেই প্রেম, প্রেম মানেই কবিতা। প্রেম ছাড়া কবিতার বই খুব একটা দেখা যায় না। ফলে মানসম্মত কবিতার বই আসছে না। তাছাড়া মানুষ মাথা খাটিয়ে চিন্তা করতে চায় না। তারা বলে কবিতা পড়ে লাভ কী? এতকিছুর মাঝেও কিছু কবিতা প্রেমী রয়েছে যারা কবিতা লেখে ও পড়ে।
বই কিনতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোজাহিদ বলেন, কবিতার ভাষা অনেক কঠিন। সাধারণ মানুষ সেগুলো কিনে পড়ার আগ্রহ দেখায় না। যা দুই-একটা পড়ে সেটাও অনলাইনে পড়ে নেয়। তাছাড়া আগে যেমন রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, আহসান হাবীব, আল মাহমুদের মতো কবিরা ছিল। এখন মানসম্মত লেখে এমন কবি নেই বললেই চলে। তবে যারা ভালো লিখেন তাদের বইয়ের কদর রয়েছে।
চলন্তিকা প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী সাবিত আলম বলেন, আমাদের স্টলে বেশ কিছু কবিতার বই এসেছে কিন্তু বিক্রি অনেক কম। আমাদের স্টলে ছোটদের ভুতের সিরিজ আর থ্রিলার উপন্যাস বেশি চলছে। পরিচিতজন আর কবিতা প্রেমী ছাড়া কেউ কবিতার বই নিতে চায় না।
কাকলী প্রকাশনীর মামুন বলেন, নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বই আমাদের স্টলে পাওয়া যায়। তবে অন্য বইয়ের তুলনায় পাঠকরা কবিতার বইয়ের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় না।
বাংলা একাডেমি থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক মোশতাক আহমেদ বলেন, যুগে যুগে মানুষের চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে, এখনো হচ্ছে। একসময় মানুষ কবিতার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করত। তখন মানুষের কাব্যগ্রন্থের প্রতি আকর্ষণ ছিল। এখন মানুষের চাহিদা কবিতা থেকে সরে থ্রিলার, উপন্যাসের দিকে বেড়েছে। তবে যারা কবিতা পড়ার তারা ঠিকই পড়ছে।
মাতৃভাষা প্রকাশের স্বত্বাধিকারী নেছার উদ্দিন আইয়্যুব বলেন, কবিতার বইয়ের পাঠক সবসময়ই কম ছিল। কবিতা হলো একটি শব্দ শিল্প, এই শিল্পকে সহজে পাঠোদ্ধার করে আনন্দ নেওয়াটা সকলের জন্য সহজ নয়। একটি ছবি যেমন মানুষ দেখতে পছন্দ করে, একজন শিল্পীর চিত্রকর্ম কিন্তু মানুষ তেমন পছন্দ করে না। পর্বতারোহণ অনেক আনন্দের হলেও সবাই সেটা করতে চায় না। তাছাড়া কবিতার বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এখানে লক্ষ-কোটি বিনোদনের উপকরণ থাকায় মানুষ সেখান থেকে বিনোদন নিচ্ছে। কষ্ট করে বই বিশেষ করে কবিতার বই পড়তে অনাগ্রহী হচ্ছে।
সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বইমেলার ১৯তম দিনে নতুন ১১৫টি বই প্রকাশ হয়।
কেএইচ/এএএ