৭২ বছরেও হয়নি ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা, ‘সম্ভবও নয়’
৭২ বছর আগে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরসহ অনেকে। ভাষার জন্য রক্তদানের দিনটিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর স্বীকৃতি দেয়।
অথচ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও হয়নি ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা। ফলে এ আন্দোলনে যোগ দেওয়া সংগ্রামীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। এ তালিকা এখন আর সম্ভব নয়, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামীদের তালিকা তৈরির আবেদন জানিয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তালিকা তৈরির নির্দেশ দেন। এরপর সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে একটি তালিকা পেশ করে। যেখানে জিল্লুর রহমান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবদুল মতিন, হাবিবুর রহমানসহ ৬৮ জন ভাষাসংগ্রামীর নাম ছিল। তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেখানে এমন কিছু নামও ছিল, যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন
তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ নয় এবং সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে— এমন অভিযোগে তালিকা প্রণয়নের কাজটিও স্থগিত করা হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ঢাকাসহ দেশের সব জেলায় কমিটি গঠন করে তালিকা তৈরি করতে বলা হয়।
সেই প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিককে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয় শুধু ঢাকায়। কমিটিতে ছিলেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনও।
এ তালিকা সম্ভব নয় : মুনতাসীর মামুন
সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত কমিটির সদস্য ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে (তালিকা তৈরি) আমরা বলেছি, এটা সম্ভব নয়। তালিকার ব্যাপারে আমি উৎসাহীও না।
‘এটি অনেক আগের ব্যাপার। যারা ছিলেন, সবাই মারা গেছেন। শুধু রফিক সাহেব আছেন। ফলে সবাই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, এ ধরনের তালিকার যৌক্তিকতা নেই। এ অবস্থায় কীভাবে তালিকাটা হবে?’
‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়েছে, সেখানে বিভেদের সৃষ্টি হয়েছে। এটা সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করা হয়। আমরা বলেছি— এটা সম্ভব নয়। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেওয়া হবে’— জানান তিনি।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
১৯৪৭ সালে সাবেক ব্রিটিশ ভারত ভেঙে দুটি দেশ গঠন করা হয়। একটি ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভারত এবং অপরটি ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ পাকিস্তান। তৎকালীন পূর্ব বাংলা (এখনকার বাংলাদেশ) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়ায় এ ভূখণ্ড পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। নাম দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান। আর এখনকার পাকিস্তানের নাম হয় পশ্চিম পাকিস্তান। দুটি অংশ মিলে একত্রে পাকিস্তান একটি দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হয়।
দেশ গঠনের কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ চান তাদের রাষ্ট্রভাষা হোক বাংলা। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যার হিসাবে তখন গোটা পাকিস্তানে বাংলাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা। পশ্চিম পাকিস্তানিদের চক্রান্তের খবর পেয়ে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়। গড়ে ওঠে তমুদ্দিন মজলিশ নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের আহ্বানে বাংলার ছাত্র-শিক্ষক, লেখক বুদ্ধিজীবীরা ভাষার দাবিতে রাজপথে নেমে আসেন।
ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে প্রথম ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে শুরু হয় মূল আন্দোলন। এরপর ক্রমে দুর্বার হয়ে ওঠে আন্দোলন। গড়ে তোলা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা ঘোষণা দেয় উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ঢাকায় এক সমাবেশে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করার পর উপস্থিত ছাত্ররা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা সবাই না না বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানান। তখন থেকে দানা বাঁধতে শুরু করে ভাষা আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। স্লোগান ওঠে— রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পায়। এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে শহীদ হন অনেক ছাত্র। তাদের মধ্যে আছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর।
এ ঘটনায় ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরাও প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসেন।
একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিটি মানুষের দাবি হয়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করার পর ওই বছরের ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। এভাবে বুকের রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বাঙালি জাতি। বিশ্বের ইতিহাসে যা এক বিরল ঘটনা।
ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে। এই আন্দোলনের রেশ ধরেই বাঙালি নিজেদের সব অধিকার আদায়ে সচেতন হয়ে ওঠে এবং একের পর এক আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবেই পরবর্তীতে ৬৬’র ৬ দফা এবং ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পার হয়ে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। ৯ মাস যুদ্ধের পর আসে বাঙালির হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
বাংলাদেশ ও বাঙালি তাই কোনদিন ভাষা আন্দোলন এবং এতে আত্মদানকারী বীর শহীদদের ভুলবে না। একুশের এই পরম সত্য নিয়ে অমর গান রচনা করেছেন আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...।’
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি
১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানান।
সে সময় কফি আনানের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে আসে চিঠিটি। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি রফিকুল ইসলামকে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন।
পরে রফিকুল ইসলাম আব্দুস সালামকে সঙ্গে নিয়ে ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজিভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারও কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন এবং চিঠির একটি কপি ইউএনওর কানাডীয় দূত ডেভিড ফাওলারের কাছে প্রেরণ করেন।
১৯৯৯ সালে তারা ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। আনা মারিয়া পরামর্শ দেন, তাদের প্রস্তাব পাঁচটি সদস্য দেশ– কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ থেকে আনতে হবে।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সেখানে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
এরপর ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এ নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। সেখানে বলা হয়- ‘এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ’।
এসএইচআর/এমজে