নিমতলী ও চুড়িহাট্টার ব্যর্থতায় আরমানিটোলার সৃষ্টি
সবশেষ অগ্নিকাণ্ড ঘটে আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানসন/ ছবি: ঢাকা পোস্ট
প্রথম দুর্ঘটনাটি ঘটে আজ থেকে ১১ বছর আগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে। রাসায়নিক গুদাম থেকে সূত্রপাত হওয়া আগুনে পুড়ে ১২৪ জন মানুষ মারা যান। দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি ঘটে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের ঠিক ৯ বছর পর চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। এ ঘটনায়ও ৭১ জন মানুষ রাসায়নিক গুদাম থেকে সৃষ্ট আগুনে পুড়ে মারা যান।
সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটে প্রথম ঘটনার প্রায় ১১ বছর পর বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানসনে। এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত চার জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ২১ জন আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
প্রথম ঘটনা থেকে সর্বশেষ ঘটনার সময়ের দূরত্ব ১১ বছর হলেও পুরান ঢাকার চিত্র কিন্তু একই। এই ১১ বছরে তিনটি বড় দুর্ঘটনা ঘটলেও পুরান ঢাকা থেকে সরেনি রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম। কয়েক বছর পরপর এমন বড় দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণ যায় অনেকের। আর তখন কিছু দিনের জন্য তৎপর হতে দেখা যায় প্রশাসনকে।
সময়ের ব্যবধানে মানুষ যখন এসব ঘটনা ভুলে যায়, তখন সিটি করপোরেশন ও মন্ত্রণালয়ের লোক দেখানো অভিযানও বন্ধ হয়ে যায়। পরে ধীরে ধীরে আবার পুরান ঢাকা তার স্বরূপে ফিরতে থাকে। আবারও যেন অপেক্ষায় থাকে বড় একটি রাসায়নিক দুর্ঘটনার।
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিমতলী ও চুড়িহাট্টার পর সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় আরমানিটোলার ঘটনা ঘটছে। নিমতলীর পর যদি সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিত তাহলে চুড়িহাট্টা হতো না। আর চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি না হলে আরমানিটোলাও সৃষ্টি হতো না। সরকার এসব দুর্ঘটনার পর বরাবরই শুধু আশ্বাস ও লোক দেখানো অভিযানে সময় পার করছে। কিন্তু পুরান ঢাকার ঘনবসতি এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরান ঢাকায় যারা রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা করে, তারা অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী। সামাজিকভাবেও তারা খুব সংঘবদ্ধ। আর তাদের এই সংঘবদ্ধতার কারণেই কিন্তু কোনো সরকার এসে তাদের এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য করতে পারছে না। রাজনৈতিক ভাবেও তারা অনেক প্রভাব ফেলে। তাই সরকারের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। দ্রুত আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া স্থায়ীভাবে রাসায়নিক গুদাম সরানোর যে প্রকল্প শিল্প মন্ত্রণালয় নিয়েছে, তাদের তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার পেছনে সংঘবদ্ধ ওই ব্যবসায়ীদের গোষ্ঠী থাকতে পারে। তবে সরকার যদি দ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেই ফেলে তাহলে ব্যবসায়ীদের ওইখানে (নির্ধারিত স্থান) যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।
নিমতলীর পর সিদ্ধান্ত হয় রাসায়নিক পল্লি নির্মাণের
নিমতলী ট্র্যাজেডিতে ১২৪ জনের নিহত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে সরকার। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানোর জন্য কেরানীগঞ্জে স্থায়ী রাসায়নিক পল্লি নির্মাণ করা হবে। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা কথা ছিল বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক)। ২০১০ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ৯ বছর পার হয়ে গেলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয়নি। সব কিছুই রয়ে গেছে কাগজে কলমে।
এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকায় ঘটে যায় চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি। আবার নতুন করে আলোচনায় আসে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম সরানোর বিষয়টি। সেসময় রাসায়নিক স্থায়ী পল্লি নির্মাণে সরকারকে নতুন করে তৎপর হতে দেখা যায়। চুড়িহাট্টার ঘটনার পর সরকার সিদ্ধান্ত নেয়- কেরানীগঞ্জে নয় মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩১০ একর জমিতে গড়ে তোলা হবে রাসায়নিক শিল্পপল্লি।
বিসিক সূত্রে জানা যায়, নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। যার নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে এখনও ধীরগতি। নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
স্থায়ী পল্লির আগে অস্থায়ী গুদামের সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন হয়নি
চুড়িহাট্টা ট্যাজেডির পর সরকার আরেকটি সিদ্ধান্ত নেয় যে স্থায়ী রাসায়নিক শিল্পপল্লি নির্মাণ হওয়া আগ পর্যন্ত পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা এবং গুদাম শ্যামপুর ও টঙ্গীতে সরিয়ে নেওয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার কথা শিল্প মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু গত দুই বছরে এই প্রকল্পও আলোর মুখ দেখেনি। অন্যদিকে পুরান ঢাকা থেকে একটি গুদাম অস্থায়ীভাবে নির্ধারিত জায়গায় সরে যায়নি।
বিসিক সূত্রে জানা যায়, অস্থায়ী রাসায়নিক গুদাম নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ১৬৮ কোটি টাকা। প্রকল্প অনুযায়ী, শ্যামপুরের উজালার বস্তিতে যাবে ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের রাসায়নিক গুদাম ও টঙ্গীতে যাবে ৫৩টি রাসায়নিক গুদাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত সব কিছু আছে কাগজে কলমে। বাস্তবে একটি রাসায়নিক গুদামও পুরান ঢাকা থেকে সরাতে পারেনি সরকার। এ বিষয়ে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা জানান, অস্থায়ী গুদাম নির্মাণের কোনো ধরনের কার্যক্রমই শুরু হয়নি। অবকাঠামোগত কোনো নির্মাণ না থাকায় তারা যেতে পারছেন না।
এত ট্র্যাজেডির পরও পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণার পর টানা ১৫ দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলে। অভিযানে পুরান ঢাকার অনেক রাসায়নিক গুদাম সিলগালাও করা হয়। কিন্তু আস্তে আস্তে অজানা কারণে বন্ধ হয়ে যায় এসব অভিযান। আবারও ধীরে ধীরে পুরান ঢাকায় জমে উঠে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা। অভিযানে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাসায়নিক গুদামগুলোর মালিকরাও আবার ভিন্ন নামে ভিন্ন জায়গায় তাদের ব্যবসা শুরু করেন।
এছাড়া বিভিন্ন সময় সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো পুরান ঢাকা জুড়ে রয়েছে অসংখ্য রাসায়নিক গুদাম। বিভিন্ন অলিতে গলিতে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় এসব রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা চলছে। অবৈধভাবে রাসায়নিক দ্রব্যের এই ব্যবসা চলছে প্রশাসনের কিছু লোকজনকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় সব মিলিয়ে ২০ হাজারের বেশি রাসায়নিক গুদাম আছে। এসব গুদামের অধিকাংশের কোনো অনুমোদন নেই। অবৈধভাবে তাদের কার্যক্রম চলছে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়েই।
এ বিষয়ে পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের বাপ-দাদারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পুরান ঢাকায় অনেক বছর আগে থেকেই এ ব্যবসা চলে আসছে। এখন চাইলে হুট করে তারা ব্যবসা বন্ধ করতে পারবেন না। সরকার গুদাম সরানোর বাস্তবমুখী ও কার্যকরি সিদ্ধান্ত নিলে তারা এ বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন।
পুরান ঢাকায় আর রাসায়নিক গুদাম চান না বাসিন্দারা
পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম থেকে সৃষ্টি অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, তারা আর কেমিক্যালের সঙ্গে বসবাস করতে চান না। তারা চান সরকার যেন দ্রুত পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেয়।
এ বিষয়ে চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে ছেলে হারানো বাবা মো. নাসির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাসায়নিক গুদাম যে জায়গায় রয়েছে, সেই জায়গায় আমরা থাকতে চাই না। আমরা লোক দেখানো অভিযান চাই না। আমরা চাই সরকার পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করুক। এমন আর একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার মতো পর্যাপ্ত কেমিক্যাল পুরান ঢাকায় রয়েছে। যেমন বন জঙ্গলে একসঙ্গে হরিণ ও বাঘ থাকতে পারে না, তেমনি পুরান ঢাকার এ ঘনবসতি এলাকায় মানুষ আর কেমিক্যাল একসঙ্গে থাকতে পারে না।
এদিকে শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আরমানিটোলায় অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দেখতে এসে ঢাকা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, কেমিক্যাল বিষাক্ত জিনিস। তাই যতদিন এ ধরনের গোডাউন আবাসিক এলাকা থেকে সরানো না হবে, ততদিন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এ ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন যাদের আছে, তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করব। এখনও কী পরিমাণ কেমিক্যাল সেখানে মজুদ রয়েছে এ বিষয়ে বিস্ফোরক অধিদফতর খতিয়ে দেখছে।
অন্যদিকে আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, পুরান ঢাকায় এখনও যথেষ্ট পরিমাণে বিভিন্ন ভবনের নিচে রাসায়নিক গুদাম রয়েছে। আমরা হাজার বার বলে এবং প্রতিবেদন দিয়েও সরাতে পারছি না এসব রাসায়নিক গুদাম।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী ঢাক পোস্টকে বলেন, আমরা পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের ব্যবসা করতে আর কোনো ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছি না। কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের মূল কাজটি করছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এই ক্ষেত্রে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দুইটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।
ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া পুরান ঢাকায় যারা কেমিক্যালের ব্যবসা করছে, এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো নজরদারি রয়েছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদেরও সেটা প্রশ্ন যে ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া একটা লোক কীভাবে ব্যবসা করে, কীভাবে ব্যাংক লোন নেয়। তবে মাঠ পর্যায়ে আমাদের তদারকি রয়েছে। আমরা যখন মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে যাই, তখন তারা দোকানপাট বন্ধ করে পালিয়ে যায়। এসব ব্যবসায়ীদের একটা তালিকা করছি আমরা। এই তালিকা আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও পাঠাব।
মুন্সিগঞ্জে শিল্প মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় রাসায়নিক শিল্পপল্লি নির্মাণের চলমান প্রকল্পের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক সাইফুল আলম বলেন, এ প্রকল্পের মূল কাজ হচ্ছে মাটি ভরাট করা। মাটি ভরাট হয়ে গেলে বাকি কাজ এক-দুই মাসের মধ্যে টেন্ডার করা হবে। টেন্ডার হয়ে গেলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্প সমাপ্ত করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের সভায় মাটি ভরাটের কাজের অনুমোদন হয়ে গেছে। আমরা প্রথমে বিমানবাহিনী কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে মাটি ভরাটের কাজটি করার জন্য প্রস্তাব করেছি। সে সময় আমাদের এ প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়নি। তখন অনুমোদন হয়ে গেলে এতদিনে মাটি ভরাটের কাজটি হয়ে যেত।
এমএসি/এসএসএইচ