দেশে তীব্র দাবদাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। তাপমাত্রার পারদ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে সহসাই মুক্তি মিলছে না বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের পাশাপাশি কাবু চিড়িয়াখানার প্রাণীরাও। দাবদাহ থেকে বাঁচতে প্রাণীদের কেউ পানির পাত্রে কেউ বা জলাশয়ে ডুবে আছে, কেউ হা করে বাতাস খাচ্ছে আবার কেউ বা নিজের মতো করে আরাম খুঁজছে গাছের ডালে বসে বা শেডের গ্রিলে ঝুলে।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দাবদাহে মানুষের মতো প্রাণীদেরও হিট স্ট্রোকে মৃত্যু হতে পারে। তাই প্রাণীদের দিনে ২-৩ বার পর্যন্ত গোসল করানো হচ্ছে। ছিটানো হচ্ছে ঠান্ডা পানি। পরিবর্তন করা হয়েছে খাদ্যাভাসের, খাবার পানিতে দেওয়া হচ্ছে স্যালাইনও।

মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) দুপুরে মিরপুরের বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখা যায়, বি-০২ শেডের রেড ফ্রন্টেড ম্যাকাউ, রেড অ্যান্ড গ্রিন ম্যাকাউ ও রুবালিনা ম্যাকাউ পাখিগুলো একসঙ্গে ছায়ায় বসে দুপুরের আহার গ্রহণ করছে। পাশের শেডে কালোগলা বক দুটো গরমে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে হা করে আছে। তার পাশের শেডে থাকা হাড়গিলা দুটিকে প্রচণ্ড গরমে হাউজের পানিতে দাঁড়িয়ে সময় কাটাতে দেখা গেছে। খাবারে যেন মন নেই তাদের। দেখে মনে হয়েছে— প্রচণ্ড গরমে দর্শনার্থী দেখে তারা যেন বিরক্ত।

এল-০২ শেডের চিত্রা হরিণগুলোকে বট গাছের ছায়ায় দলবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে দেখা গেছে। কিছু হরিণ শেডের ছায়ায় দুপুরের খাবারে লতাপাতা খাচ্ছিল। ওই শেডে আরো একদল হরিণ দেওয়াল ও গাছের ছায়ার নিচে শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছিল। তবে দুপুরের খা খা রোদে হরিণের শেডের পুরো ময়দানে কোনো হরিণ দেখা যায়নি।

এসএম-১৩ শেডে থাকা রেসাস বানরের (লাল বানর) বাচ্চাগুলোকে এক গ্রিল থেকে আরেক গ্রিলে লাফিয়ে খেলাধুলা করতে দেখা গেছে। আবার কয়েকটি বানর ছায়ায় বসেছিল। এসএম-১৮ ও ২০ শেডের বানরগুলো পানিতে নেমে খেলাধুলা করছিল। তীব্র গরম থেকে বাঁচতে তারা যেন নিজেরা মেতেছিল জলকেলিতে।

সাপের শেডে মাথা তুলে জিহ্বা নাড়াতে দেখা গেছে অজগরকেও। গরমে যেন তারাও হাঁসফাঁস করছে। এছাড়া ভরদুপুরে গরমের মধ্যে উল্লুকের বাচ্চাকে শেডে তরমুজ খেতে দেখা গেছে। আর মা উল্লুক শেডের গ্রিলে নিজেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখেছে। দর্শনার্থীদের খেলা দেখাতে যেন তার কোনো মন নেই।

বি-০৩ শেডের রাজ ধনেশকে গ্রিলের ভেতর দিয়ে হা করে থাকতে দেখা গেছে। প্রচণ্ড গরমে রাজ ধনেশও যেন চুপসে গেছে। তবে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে জলহস্তী পার্কে গিয়ে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দলবেঁধে আহার গ্রহণ করছে তারা। আহারের মধ্যে অন্যতম ছিল তরমুজ। এছাড়া ঘাস তো রয়েছেই।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তরমুজগুলোকে দুই ভাগ করে তাদের খেতে দিয়েছে। আর জলহস্তীগুলো এক একটি টুকরো মুখে দিচ্ছে আর চিবাচ্ছে। কোথায় প্রচণ্ড রোদ, সেদিকে যেন তাদের কোনো খেয়াল নেই। খাওয়া শেষে সবগুলো জলহস্তী আবার পানিতে ডুব দেয়। তবে একটি জলহস্তীকে কাদাপানিতে দীর্ঘ সময় ডুবে থাকতে দেখা গেছে।

সাপের শেডে মাথা তুলে জিহ্বা নাড়াতে দেখা গেছে অজগরকেও। গরমে যেন তারাও হাঁসফাঁস করছে। এছাড়া ভরদুপুরে গরমের মধ্যে উল্লুকের বাচ্চাকে শেডে তরমুজ খেতে দেখা গেছে। আর মা উল্লুক শেডের গ্রিলে নিজেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখেছে। দর্শনার্থীদের খেলা দেখাতে যেন তার কোনো মন নেই

বি-০৬ শেডে তিলবাজ ঈগল ও কুড়াবাজ ঈগলদের সামনে পছন্দের খাবার মাছ পড়ে থাকলেও যেন তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাসে শেডের একদম উপরে ছায়ায় বসে তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল। শঙ্খচিল ও ভুবন চিলকেও একই অবস্থায় দেখা গেছে। এর মধ্যে একটি ঈগল শেডের বেসিনে পা চুবিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ঈম্পালা, গয়াল, গাধা, ক্যাঙারু; রোদ থেকে বাঁচতে সবাইকে ছায়ায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করতে দেখা গেছে। গরমে অস্বস্তিতে থাকা ইমুপাখিগুলোকেও ছায়াযুক্ত ভেজা জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। নানা প্রজাতির ময়ূরের মধ্যে সাদা রঙের ময়ূরদের একটিকে পেখম মেলে থাকতে দেখা গেছে। বাকিরা ছিল চুপচাপ।

সবুজ ঘুঘুকে বাঁশ ঝাড়ের নিচে হাঁটাচলা করতে দেখা গেছে। আবার কোনটা গাছের ডালে বসে ডাকাডাকি করছে। জিরাফ, জেব্রাগুলোও গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বসে বিশ্রাম করছিল। দর্শনার্থীরা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেও তারা সেদিকে কোনো মনোযোগ দেয়নি। আর অ্যারাবিয়ান ঘোড়াগুলোকে শেডের নিচে দেওয়ালের সঙ্গে ঘষাঘষি করতে দেখা গেছে। আর দেশীয় ঘোড়াগুলো প্রচণ্ড রোদের মধ্যেই দুপুরের খাবার গ্রহণ করছিল।

অন্যদিকে হাতিগুলোকে যার যার জায়গায় বেঁধে রাখা হয়েছে। তারা নিশ্চিন্ত মনে কলা গাছ চিবাচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার জবা ও জুই তার নিজের সেটের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করছিল। দর্শনার্থীরা তাদেরকে বিরক্ত করার চেষ্টা করলেও তারা কোনোভাবেই বিচলিত হচ্ছিল না। আফ্রিকান সাদা সিংহকে আরাম করে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। সে যেন কারো ডাকেই কোনো সাড়া দিচ্ছিল না।

চিড়িয়াখানায় আরও দেখা যায়, বি-০১ শেডে থাকা নিশি বক, গ্রেটার ফ্লেমিঙ্গ, পেলিক্যান, ছোট পানকৌড়ি এবং কানি বককে পানিতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কচ্ছপগুলো অল্প পানিতে ছোটাছুটি করছিল। সার্বিকভাবে চিড়িয়াখানার প্রাণীরা গরমের মধ্যে অনেকটা নাজেহাল হয়ে পড়েছে। তারপরও তাদেরকে রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।

গরমে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের স্বাস্থ্য রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে— জানতে চাইলে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ড. মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই মুহূর্তে সারা দেশে তাপপ্রবাহ বিরাজ করছে। মানুষের মতো প্রাণীকুলদের মধ্যেও অস্বস্তি বিরাজ করছে। আমাদের চিড়িয়াখানায় যে-সব প্রাণী আছে, তাদেরকে আমরা নানাভাবে একটু স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছি। খাবার পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি।

তিনি বলেন, আমাদের যে সমস্ত প্রাণীদের গোসল করানোর দরকার তাদেরকে দিনে অন্তত দুই থেকে তিনবার পর্যন্ত গোসল করানো হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি চার থেকে পাঁচবার পর্যন্ত হয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা প্রাণীদেরকে উপর থেকে পানির স্প্রে করছি। এছাড়া প্রাণীদের শেডে যে হাউজগুলো রয়েছে সেখানে পানি পরিবর্তন করে দেওয়া হচ্ছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে হাউজে পানি ছেড়ে রাখা হয়েছে। আবার কোনো কোনো শেডের উপরে চট বিছিয়ে সেখানে পানি দেওয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে মেঝেতে চট বিছিয়ে পানি দেওয়া হচ্ছে।

প্রাণীদের খাবারের বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদেরকে ইলেকট্রোলাইট দেওয়া হচ্ছে, ভিটামিন-সি দেওয়া হচ্ছে। খাদ্যাভাসে কিছুটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে তরল খাবার বেশি দেওয়া, সহজে হজম হয় এই ধরনের খাবার দেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে আমাদের প্রাণীগুলো আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে। আমরা প্রাণীকুলকে স্বস্তি দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

জাতীয় চিড়িয়াখানার তথ্য বলছে, চিড়িয়াখানায় মোট খাঁচা আছে ১৩৭টি। এসব খাঁচার প্রকোষ্ঠ আছে ২৩৭টি। চিড়িয়াখানায় মোট প্রাণী রয়েছে তিন হাজার ৩৪২। এর মধ্যে বৃহৎ প্রাণী (তৃণভোজী) ১৮ প্রজাতির ৪০১টি, মাংসাশী ১১ প্রজাতির ৪০টি,  ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ১১ প্রজাতির ১১৬টি, সরীসৃপ ৯ প্রজাতির ৭৫টি, পাখি ৫০ প্রজাতির ১ হাজার ৬৫৯টি, এ্যকুরিয়াম ফিস ২৫ প্রজাতির এক হাজার ৫১টি রয়েছে

তাপমাত্রা কতটুকু বাড়লে তা প্রাণীদের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে— জানতে চাইলে চিড়িয়াখানার পরিচালক বলেন, বর্তমানে যে দাবদাহ চলছে তাতে করে কোনো কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের কথা বিবেচনা করেই আমরা উপরের ব্যবস্থাগুলো নিয়েছি।

এদিকে চিড়িয়াখানায় গরমের মধ্যে দর্শনার্থী থাকলেও সে সংখ্যা ছিল খুবই অল্প। যারা ছিলেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগকে গাছের ছায়ায় ঘাসে বসে বা বিশ্রাম শেডের নিচে বসে বিশ্রাম করতে দেখা গেছে।

জাতীয় চিড়িয়াখানার তথ্য বলছে, চিড়িয়াখানায় মোট খাঁচা আছে ১৩৭টি। এসব খাঁচার প্রকোষ্ঠ আছে ২৩৭টি। চিড়িয়াখানায় মোট প্রাণী রয়েছে তিন হাজার ৩৪২। এর মধ্যে বৃহৎ প্রাণী (তৃণভোজী) ১৮ প্রজাতির ৪০১টি, মাংসাশী ১১ প্রজাতির ৪০টি,  ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ১১ প্রজাতির ১১৬টি, সরীসৃপ ৯ প্রজাতির ৭৫টি, পাখি ৫০ প্রজাতির এক হাজার ৬৫৯টি, এ্যকুরিয়াম ফিস ২৫ প্রজাতির এক হাজার ৫১টি রয়েছে।

এমএইচএন/এমজে