১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়
বোনাস লাইফ নিয়ে কেটে গেছে ৩০ বছর
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের রাতে ছেড়েই দিয়েছিলাম বেঁচে থাকার আশা। আমার জীবনটা শেষ হয়ে যেতে পারতো ৩০ বছর আগেই। সেই ভয়াল কালো রাতে খুব কাছে থেকেই দেখেছিলাম মৃত্যুকে। কিন্তু রাতভর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে গিয়েছিলাম, অনেকটা বোনাস লাইফের মতো। আর সেই বোনাস লাইফ নিয়েই কেটে গেছে ৩০ বছর।
ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল স্মৃতির বর্ণনা এভাবে ঢাকা পোস্টের কাছে উপস্থাপন করেছেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ম.শামসুল ইসলাম।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে আমার বয়স ১৯ বছর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হয়েছিলাম। চোখ বন্ধ করলে এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই বিভীষিকাময় রাতের স্মৃতিগুলো। মনে পড়ে সেই রাতে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের কথা।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, মহেশখালী ও সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ে সারা দেশে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। সর্বস্ব বিলীন হয় প্রায় ১ কোটি মানুষের। ১৯৯১ সালে এই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ৩০ বছর পার হলেও এখনো উপকূলীয় এলাকায় নির্মাণ করা হয়নি স্থায়ী বেড়িবাঁধ।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর গ্রামে আমাদের বাড়ি। বাড়ি থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর আর আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে ছিল শংখ নদ। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল, দিনটি ছিল সোমবার। সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। হালকা বাতাস ছিল। গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল, তবু ভ্যাপসা গরম কাটছিল না। দুপুরের পর থেকে আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলাম। ক্রমশ বাড়ছিল বাতাসের গতি। দুদিন আগেই নিম্নচাপের সংকেত দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদফতর। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় আগের রাতেই। সেই রাতেই সম্ভাব্য বিপদের পূর্বাভাস জানানো হয় আবহাওয়া অধিদফতর থেকে। বিকেল ৫টার পর থেকে বেড়ে যায় বাতাসের গতি, একই সঙ্গে বৃষ্টিও। সন্ধ্যার পর শুরু হয় ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটা। মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়া বইছিল। মনে হচ্ছিল যেন টিনের চালা খুলে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, মাটির দেয়াল আর উপরে টিন শেড দেওয়া ঘরে ছিলাম আমি, মা ও ভাগিনী। রাত ৯টার দিকে আমার এক ভাই বৃষ্টির মধ্যে এসে আম্মাকে জানালেন ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের কথা। বললেন, সাইক্লোন শেল্টার কিংবা দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু আম্মা রাজি হলেন না। বললেন- বিল খাল শুকনো। পানি আসলে তা তো জমিই চুষে নেবে। বাড়ির অনেকেই এসময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও আমরাসহ বাড়ির ১১টি পরিবারের বাকি সদস্য থেকে গেলাম। বাইরে প্রচণ্ড গতিতে হচ্ছিল ঝড়। ঝোড়ো হাওয়া আর বর্ষণের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছিল না তখন। মনে মনে ভয় লাগলেও ভরসা দিচ্ছিলেন আম্মা। হারিকেন জালিয়ে একটি কক্ষে এসে বসে রইলাম আমরা তিনজন। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল দমকা হাওয়া আমাদের ঘরটিই হয়ত উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, রাত ১২টার দিকে জানালা ফাঁক করে বাইরে টর্চ লাইটের আলো ফেলতেই দেখি ঘরের দেয়ালের কাছেই পানি। তড়িঘড়ি করে আম্মা আর ভাগিনীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। আমার ডাকাডাকিতে ৫ বছরের ছেলে বাদশা আর ৩ বছরের মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো জেঠাতো ভাই ফয়েজ ও তার স্ত্রী। এলেন জেঠাত বোন আয়েশা, তার স্বামী আছদ আলী ও মেয়ে ফাতেমা।
শামসুল আরও বলেন, বাড়ির উঠানে তখন কোমর সমান পানি। সবাই মিলে পানি মাড়িয়ে ভিটের উত্তর পূর্ব পাশে থাকা খড়ের গাদায় গিয়ে উঠলাম। প্রথম দফায় শংখের বাঁধ বিলীন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব থেকে আসা পানি দ্রুত বাড়ছিল তখন। এ অবস্থায় আমরা একে অপরকে ধরে একসঙ্গে জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলাম । কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারিনি। রাত সাড়ে ১২টায় দ্বিতীয় দফায় বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যায় খড়ের গাদাটি। আমার চোখের সামনেই অল্প খড়সহ বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে গেলেন আম্মা ও ভাগিনী বিলকিস। তাদের ধরে রাখার কোনো চেষ্টাই কাজে আসল না। একইভাবে একে একে ভেসে গেলেন আয়েশা ও তার স্বামী আছদ আলী। ছেলে বাদশা আর মেয়ে মুন্নীকে কাঁধে নিয়ে খড় ধরে ভেসে গেলেন জেঠাত ভাই ফয়েজ। বাকি রইলাম আমি, ফয়েজের স্ত্রী ও ফাতেমা।
ভয়ংকর সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, প্রাণের মায়া তখনো ছাড়িনি। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে একটি খালি চালা এসে ঠেকল খড়ের গাদা ও পার্শ্ববর্তী ফুল গাছের সঙ্গে। আমরা তিনজনই তাতে উঠে পড়লাম। দশ মিনিটের মতো ওই অবস্থায় ছিলাম। এরপর হঠাৎ পানির প্রচণ্ড স্রােত আমাদেরসহ চালাটি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল পূর্ব দিকে। প্রায় আধ কিলোমিটার যাওয়ার পর চালা থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম আমি। মনে হলো এখানেই জীবন শেষ, বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিলাম। এ সময় হঠাৎ ভেসে উঠলাম পানির উপরে। ঝড়ে ডালপালা ভেঙে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা কড়ই গাছ পেলাম সামনে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম গাছটি। এক একটি ঢেউ এসে চলে যাচ্ছিল মাথার উপর দিয়ে। গাছটি জড়িয়ে ধরে ঢেউয়ের বিপরীতে অনেক কষ্টে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছিলাম। ঢেউ যাওয়ার পর মাথাটা কোনো রকম পানির উপরে তুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। গাছটির ডালপালা না থাকায় উপরে উঠারও কোন সুযোগ ছিল না।
শামসুল ইসলাম বলেন, তখন গভীর রাত। পানির নিচে ডুবে গেছে পুরো উপকূলীয় এলাকা। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। মনে হচ্ছিল যেন সাগরের মাঝে ভাসছি আমি। এভাবে ঝড় আর ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেই কাটে সারারাত।
তিনি বলেন, রাত ৩টার পর থেকে পানি কমতে শুরু করে। পানি কমে যাওয়ার পর সকাল ৭টার সময় নেমে আসি গাছ থেকে। তখনো বুক সমান পানি। সাঁতার কেটে কোনোরকম উঠে এলাম বাড়ির সামনের রাস্তায়। এ সময় রাস্তার দুপাশে দেখা যাচ্ছিল কেবল লাশ আর লাশ। চিৎ, কাত, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বিবস্ত্র নারী পুরুষের লাশ, সন্তান বুকে মায়ের লাশ, অসংখ্য মরা গরু ছাগল।
তিনি বলেন, চোখের সামনে ভেসে যাওয়া আম্মা-ভাগিনী, প্রতিবেশী কারো বেঁচে থাকার আশাই করতে পারছিলাম না তখন। বাড়িতে ফিরে দেখি ঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। শূন্য ভিটায় ভেজা কাপড়ে বসে কাঁদছেন আম্মা। তিনি জানালেন, খড়সহ ভেসে যাওয়ার পথে একটি গাছ ধরে রাতভর মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন তিনি। একইভাবে বেঁচে যায় ভাগিনী বিলকিসও। কিন্তু চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় জেঠাত ভাই ফয়েজ, তার ছেলে বাদশা ও মেয়েসহ আমাদের বাড়ির তিনটি পরিবারের ১৬ সদস্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেলেনি অনেকের লাশের সন্ধান।
তিনি আরও বলেন, আমার জীবনটাও থেমে যেতে পারতো সেই রাতেই। আরও অনেকের মতো রাস্তার ধারে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকতে পারতাম। হাজারো লাশের মধ্যে হয়ত মিলত না আমারও পরিচয়। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল। তাই মৃত্যুর একদম কাছ থেকেও ফিরে আসতে পেরেছি।
কেএম/এসকেডি