কেউ এসেছেন উত্তরবঙ্গ থেকে, কেউবা দক্ষিণ থেকে। আবার কেউ কেউ দেশের উত্তর-পশ্চিমসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। সবাই গ্রামের মানুষ। নিজ এলাকায় কাজের সুযোগ মেলেনি। তাই খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার তাগিদে ছুটে এসেছেন রাজধানীতে।

বছরের পর বছর ইট-পাথর-কংক্রিটের শহরে শরীরের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের রোজগারে তারা কোনোভাবে টিকিয়ে রেখেছেন সংসার। কিন্তু এবার বুঝি আর কোনো কিছুতেই রক্ষা হয় না। প্রতিদিন কাজের আশায় ঘর থেকে বের হলেও মিলছে না কাজ। সবার প্রশ্ন, আর কত দিনের পর শূন্য হাতে ঘরে ফেরা?

সরেজমিনে রাজধানীর ‍উত্তরার আজমপুর এলাকার ফুটওভার ব্রিজের নিচে বসে থাকা এসব দিনমজুর ও শ্রমিকদের চোখে মুখে দেখা গেল অসহায়ত্ব আর কাজ না পাওয়ার কষ্ট। তাদের একটাই কথা, বেঁচে থাকার জন্যে চাই কাজ। কিন্তু করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের কারণে মিলছে না কাজ।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে অনেকেই অভিযোগের সুরে বলে ওঠেন, কেউ তাদের দিকে নজর দেয় না। খামোখা এসব ছবি তুলে- লিখে নিয়ে কোনো লাভ নেই। খালি তাদের মতো গরীবের পেটে লাথি পড়ে।

কোন সহযোগিতা পান কি না- প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই সবাই এক গলায় বলেন, ‘না’। ত্রিশোর্ধ্ব নারীশ্রমিক শেফালী বলেন, কাজ পাইলে খাই, না পাইলে না খাইয়া থাকি। আমরা তো আর চুরি করতে চাই না। কাজ করে খেতে চাই। সেই সুযোগও আমাগো কেউ দিচ্ছে না।

এসব শ্রমিকরা বলেন, তাদের কাছ থেকে এর আগে মোবাইল নম্বর নেওয়া হয়েছে। নেওয়া হয়েছে ভোটার আইডিও। কিন্তু টাকা পাননি কেউই। এক কেজি চাল পর্যন্ত তারা পাননি। অনেক মানুষের কাছে তারা কান্না-কাটি করেছেন। কোনো লাভ হয়নি।

নরসিংদী থেকে জীবিকার টানে রাজধানীতে আসা রেখা তিন সদস্যের পরিবারের সব ভার একাই বহন করেন। তিনি বলেন, গত বছরও লকডাউনে কারো কাছ থেকে ৫ বা ১০ টাকাও সহযোগিতা পাই নাই। কাজও পাই নাই। ধার-দেনা করে চলছি। ঘর ভাড়া দিতে না পারার যে কী কষ্ট, তা বলে বোঝানো যাবে না।

উত্তরবঙ্গ থেকে আসা চাঁন মিয়া বলেন, গেল বছরের লকডাউনের কারণে অনেক ক্ষতি হইছে। সেই ক্ষতির কিছুটা পূরণ হইছিল। এবার আবার সেই লকডাউন শুরু হইলো। এখন আগের ক্ষতি পোষাবো না কি, দুই মুঠো খেয়ে-পরে বাঁচার জন্যে পথে পথে ঘুরবো? শ্রমিকের জীবন এত কষ্টের হয়! কথাগুলো বলতে বলতে মন খারাপ করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেন মধ্যবয়সী এ শ্রমিক।

সরেজমিনে দেখা যায়, কোদাল, ডালি, খুন্তিসহ দিন মজুরদের কাজের বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে উত্তরার আজমপুরের ফুটওভার ব্রিজের নিচে এসব শ্রমিক কাজের আশায় বসে আছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ না পাওয়ায় অনেকেই দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছেন। তারা জানেন না, কাজ না পেলে তারা কী খেয়ে পরের বেলা কাটাবেন। সবার মুখে একটাই কথা, কাজ চাই।

কাজের আশায় বসে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে যুবক থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী অনেকেই রয়েছেন। নারী শ্রমিকদের অধিকাংশের বয়স ৩০ বছরের বেশি। বসে বসে অনেকেই নিজেদের মধ্যে হালকা গল্প সারছেন। কেউ বা নিজের সংসারের খারাপ অবস্থার কথা তুলে ধরে হালকা হওয়ার চেষ্টা করছেন।  

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, যশোর, কুষ্টিয়া, পঞ্চগড়, রংপুর, ফরিদপুর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে তারা অনেক বছর ধরে রাজধানীতে এসে দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এখানে কাজের জন্যে আসা মোট শ্রমিকের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি হবে।

১৫ বছরের বেশি সময় থেকে এখানে প্রতি সকালে তারা উপস্থিত হন। কারও শ্রমিক দরকার হলে এখান থেকে ডেকে নিয়ে যান। করোনা আসার আগেও এখানকার শ্রমিকরা অনেক কাজ পেতেন। কাউকে সেভাবে বসে থাকতে হতো না। রাজমিস্ত্রিসহ বাসা-বাড়ির বিভিন্ন কাজ করে থাকেন তারা। দিন এনে দিন খেয়ে জীবনযাপন করেন তারা।

সোহাগ নামের আরেক শ্রমিক বলেন, আজ আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এই যে লোক দেখা যায়, তাদের পরিবারে সাত থেকে আটজন করে সদস্য। কারও স্বামী প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছেন। কারও বা মা অসুস্থ। কারও বউ অসুস্থ তো, কারও বা সন্তান। তিন মাস ধরে এখানে কাজের জন্যে আসছি। কিন্তু কাজ নাই।

মধ্যবয়সী এ শ্রমিক আরও বলেন, চোখের সামনে চাঁদাবাজিসহ কত অনিয়ম হচ্ছে। কাজ শেষ হলেও টাকা দিতে অনেকেই হয়রানি করে। তারপরও আমরা পেটের দায়ে থাকি। অনেকে না খেয়ে আসছে। এ আশায় আসছে, কর্ম করব, পরে গিয়ে খাইব। আমাদের কর্মের হাত, তিন মাস ধরে বসে রইছি। এখন একেবারে কিছুই হচ্ছে না।

দাউদকান্দি থেকে এসে রাজধানীতে দিনমজুর হিসেবে জীবন শুরু করা সৌরভ বলেন, এই যে বড় বড় বিল্ডিং আছে, সবাই ঘুমায় থাকে, সেগুলো আমাগো হাতে গড়া। আজ আমরাই না খেয়ে পথে থাকি।

একে/আরএইচ