প্রবীণ নিবাসেই ২৫ বছর পার করছেন চিত্রশিল্পী মুজিবুল হক

ধানমন্ডির শংকরে নিজের উপার্জনে সাজিয়েছেন বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। সেখানে তিন মেয়ে-এক ছেলের জায়গা হলেও ঠাঁই মেলেনি তার। দীর্ঘ ২৫ বছর কেটে গেল প্রবীণ নিবাসে। এসব নিয়ে আক্ষেপ না থাকলেও ৮০ বছর বয়সী শেখ মুজিবুল হক বলেন, ‘পরিবারে আর ফিরতে চাই না। মাঝে মাঝে ফিরতে যে মন চায় না, তা নয়। ছেলে-মেয়েরা যদি বলে জায়গা হবে না, এই ভেবে ফেরা হয় না।’ 

পেশায় চিত্রশিল্পী মুজিবুল হকের বাবা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের কালেক্টর। পৈত্রিক নিবাস যশোরের শেখ পাড়া হলেও জন্ম রংপুরে। বাবা-মা’র সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন জেদি-অভিমানী শেখ মুজিবুল। ১৯৯১ সালে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর চার সন্তান, বাবা-মাকে রেখেই ২৫ বছর আগে ওঠেন আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনের ঠিক সামনেই অবস্থিত ‘প্রবীণ নিবাস’। করোনার অতিমারির মধ্যে আতঙ্ক নিয়ে আরও ৪২ প্রবীণের সঙ্গে সেখানে বসবাস তার। নিবাসের ৬০৫ নম্বর কক্ষে এখন তার বেঁচে থাকা।

সম্প্রতি প্রবীণ নিবাসে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন শেখ মুজিবুল হক। হাতে লাঠি। মুক্ত আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কথায় কথায় উঠে আসে প্রবীণ নিবাসে আসার অভিমানী গল্প। জানান, যশোর শহরের শেখ পাড়াতে বাড়ি। বাবা ব্রিটিশ আমলের কালেক্টর ছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা বাবা যা রোজগার করেছেন তাতে দুই পুরুষ চলে যাবে। তবুও বাবার ওপর ভরসা করেননি। নিজের মতো চলেছেন। কখনো নিজের ইচ্ছার ওপর বাবার ইচ্ছার প্রাধান্য দেননি।

ছেলে-মেয়েরা যদি বলে জায়গা হবে না, এই ভেবে ফেরা হয় না মুজিবুল হকের

‘ইন্টারমিডিয়েট সময় থেকেই টিউশনি করে নিজের খরচ নিজে চালাতাম। ঢাকা কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স করেছি রেকর্ড মার্কস নিয়ে। শখ ছবি আঁকার। জীব-জন্তু নয় প্রকৃতির ছবি আঁকতেই বুঁদ থাকতাম। যে কারণে জাপান থেকে সরকারি খরচে স্কলারশিপ পাওয়ার পরও যাইনি। এখন মনে হয় শয়তানে ভর করেছিল। না গিয়ে বরং ভুল করেছি। আজ আমার জায়গা এই প্রবীণ নিবাস।’

রাজধানীর লালমাটিয়ার একটি ইংলিশ মিডিয়াম কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন শেখ মুজিবুল হক। তবে, বেশি টেনেছে ছবি আঁকাআঁকিতে। দীর্ঘ ২৫ বছর প্রবীণ নিবাস জীবনের অধিকাংশ সময় পার করেছেন ছবি এঁকে।

তিনি বলেন, ‘বাবা ছিলেন পরিবার-অন্তঃপ্রাণ। মানে, তার সহায়-সম্পদ বলতে সবকিছুই দিয়ে গেছেন ভাই ও বোনদের। ১৯৯১ সালে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর অনেকটা ভেঙে পড়ি। পরে ফুফুই আমাকে এ প্রবীণ নিবাসে উঠিয়ে দিয়ে যান। তারপর আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করিনি।’

‘স্বার্থপরতার চেয়ে একাকিত্বই আমার ভালো লাগে। গান গাওয়া আর ছবি আঁকতেই কেটে যায় সময়। যখন ভালো লাগে না তখন এ বারান্দায় বসি। ভালো লাগে। দক্ষিণা হাওয়া এসে দোল দিয়ে যায় আর ভাবি, এই বুঝি মরণ এসে পড়ল।’

মন খারাপ হলে প্রবীণ নিবাসের বারান্দায় সময় কাটান মুজিবুল হক

শেষ আশ্রয়স্থল সম্পর্কে শেখ মুজিবুল হক বলেন, ‘এখানে বিশেষ কোনো সমস্যা নেই। খাবারের মান আগের চেয়ে বেশ ভালো। তবে করোনার ভয় আছে। আমি একা। একা একা থাকতেই যেন এখন একা লাগে। তবুও হঠাৎ পরিবার, সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে মন চায়। একমাত্র ছেলেকে, বড় মেয়েকে, ভাগ্নেকে দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ফেরা হয় না। সন্তানরা যদি বলে জায়গা নেই! এই ভেবে ফিরি না।’

২৫ বছরের সঙ্গী নষ্ট টেলিভিশন

এখানে আসার সময় একটা টেলিভিশন নিয়ে এসেছিলাম। তা দেখে দেখে সময় কেটে যেত। কিছুদিন হলো টিভিটা ডিস্টার্ব দিচ্ছে। মেকারকে দেব কিন্তু করোনায় তো বের হতে পারি না। টাকাও নেই, তাই আর ঠিক করা হয় না। আমার কোনো চাহিদা নেই। বড় মেয়েই খরচ দেয়। বাড়তি টাকা কখনো চাই না।

মুজিবুল হক বলেন, প্রবীণ নিবাসই এখন আপন। যারা পরিবার-সন্তান থাকতেও একা তারাই আসেন এখানে। এটা এখন একটা কমিউনিটি। আমরা নিজেরা কথা বলি, কাউকে না পেলে নিজে নিজে কথা বলি। আকাশের পানে তাকিয়ে থাকি। ছবি আঁকি।

প্রবীণ নিবাসের ম্যানেজার আব্দুর রহমান সুমন বলেন, ২৫ বছর ধরে এই হোমে আছেন মুজিবুল আঙ্কেল। অনেকবার কথা বলেছি, গল্প করেছি। খুবই খোলা মনের মানুষ। কিন্তু প্রচণ্ড জেদি, অভিমানীও। এখানে তিনি থাকেন নিজের জন্য। তবে বয়স বেড়েছে, এখন প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। ওনার বড় মেয়ে আসেন, দেখা করেন। গল্প করে চলে যান।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান 

বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের (বাইগাম) সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। সরকারি সহায়তা খুব কমই পাই। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই খরচ বহন করতে হয়। এখানকার অধিকাংশ নিবাসীই সম্ভ্রান্ত। কেউ চিকিৎসক, কেউ শিক্ষক, কেউ আইনজীবী অথবা বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকর্তা ছিলেন। নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করেন তারা।

জেইউ/এসএম/এমএআর/