ফেরিতে গাদাগাদি করে যাত্রীর অবস্থান বাড়িয়ে দিতে পারে করোনা সংক্রমণ

করোনার সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের কারণে এবার ঈদ উপলক্ষে বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়নি কোনো গণপরিবহন। তারপরও থেমে নেই মানুষের ঈদযাত্রা। ট্রাকসহ পণ্যবাহী বিভিন্ন যানবাহন থেকে শুরু করে মোটরসাইকেলেও ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছে মানুষ। 

সবশেষ খবর অনুযায়ী সোমবার (১০ মে) বিকেলে ফেরি চলাচলের অনুমতি দিয়েছে সরকার। এতে করোনা সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন : করোনা কিংবা পথের ভোগান্তি রুখতে পারেনি ঈদযাত্রা

বুয়েটের অধ্যাপক ড সামছুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিধিনিষেধ না মেনে ঈদযাত্রায় যাত্রীরা কী করতে পারেন সেটা আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কি আঁচ করতে পারেননি? আগাম ব্যবস্থা কি নেওয়া যেত না? বর্তমান অবস্থায় করোনা সংক্রমণ কমার পরিবর্তে বাড়ার আশঙ্কাই বেশি হলো।’

রাজধানীর গাবতলী-আমিনবাজার, মহাখালী, আব্দুল্লাহপুর, সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কাঁচপুর, ফুলবাড়িয়া ঘুরে দেখা গেছে বাস বন্ধ থাকলেও বিকল্প পরিবহনের জন্য অপেক্ষা করছেন হাজার হাজার যাত্রী। অনেকেই ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ ও মোটরসাইকেলে করে বাড়ি যাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে গাড়ির চাপও বেড়েছে। সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ৯ মে রোববার ভোর ৬টা থেকে সোমবার (১০ মে) ভোর ৬টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ৩১ হাজার ৮০২টি যানবাহন পারাপার হয়েছে। পরিবহন পারাপারের এই সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ।

আরও পড়ুন : সুনসান নীরবতায় ভিন্ন রূপে মহাখালী বাস টার্মিনাল

ঢাকা- টাঙ্গাইল মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব পর্যন্ত ১৪ কি‌লোমিটার এলাকাজু‌ড়ে যানবাহ‌নের দীর্ঘ সা‌রি সৃ‌ষ্টি হ‌য়েছে। ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধি জানান, সোমবার (১০ মে) সকাল থে‌কে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়‌কে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও ট্রা‌কের চাপ বেশি ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের চাপ আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও ট্রাক, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন বাহনে যাত্রীরা বাড়ির দিকে যাচ্ছেন।

ঢাকার নতুন বাজার থেকে যাত্রী নিয়ে মোটরসাইকেল চালক সোহেল মাহমুদ গত তিন দিন ধরে ময়মনসিংহে যাতায়াত করছেন। তিনি বলেন, আগের চেয়ে মহাসড়ক ফাঁকা। গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহে এক ঘণ্টায় যাওয়া যাচ্ছে। একজন যাত্রী নিলে ৭০০ টাকা পাচ্ছি।

এদিকে ফেরিতে পদ্মা পারাপারের জন্য যাত্রীর ভিড় লেগেই আছে। বিকল্প পরিবহনে ঘাটে ঘাটে যাত্রীর উপস্থিতি বাড়ছে। জরুরি সেবার পরিবহন পারাপারের জন্য নির্ধারিত ফেরিতে ঈদযাত্রীরা উঠে পড়ছেন হুড়মুড়িয়ে। 

ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধি জানান, পাটুরিয়ার ৪ নম্বর ফেরিঘাট থেকে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স ও একটি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সসহ হাজারো যাত্রী নিয়ে সাড়ে ৯টায় ছেড়ে যায় চন্দ্রমল্লিকা ও হাসনাহেনা ফেরি। এরপর ১১টার দিকে বনলতা নামে আরেকটি ছোট ফেরি ঘাট ছেড়ে যায়।

আরও পড়ুন : ঈদযাত্রায় যত বিপত্তি দক্ষিণের যাত্রীদের

অন্যদিকে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে পাটুরিয়া ঘাটে আসে তিনটি ফেরি। ফেরির র‌্যাম খোলামাত্রই যাত্রীরা হুড়মুড় করে উঠে পড়েন। এতে স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্বের কোনো বালাই ছিল না। ঝুঁকি জেনেও বাড়ি ছুটছে মানুষ। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।

বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, এবার গবাতলী টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। আমরা চাই দূরপাল্লার বাস চালু হোক। এ দাবি আমরা সরকারের কাছে জানিয়েছি। এতে বরং করোনার ঝুঁকি কম থাকবে। কারণ দুই সিটে একজন করে বসবে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবকিছু চালু আছে। দূরপাল্লার বাস শুধু চালু নেই। এবার বাস বন্ধ থাকলেও যাত্রীরা দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। অন্যান্য বার দুর্ভোগ দেখা যায় সড়ক ও রেল পথে। এবার এই দুর্ভোগ ধরা পড়ছে শুধু ফেরিতে।

বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। করোনা সংক্রমণের মধ্যে আমরা ঈদ করতে বাড়ি যেতে পারি না। আমি নিজেও বাড়ি যাচ্ছি না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করে ঈদ করার জন্য। এভাবে আমরা করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারি না। (যদিও সবদিক বিবেচনা করে সোমবার বিকেলে ফেরি চলাচলের অনুমতি দিয়ে দেয় সরকার)।

করোনাকালে মানুষের এমন যাতয়াতের প্রভাব কী হবে- জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই এই লকডাউন, কিন্তু এর মধ্যে যদি যাতায়াত বেড়ে যায়, তাহলে তো কিছুই হলো না। এতে করে গ্রামে গ্রামে আরও নতুন সংক্রমণ ছড়াবে। আমি মনে করি, সংক্রামক ব্যধি মোকাবিলার প্রস্তুতির মূল কাজ হলো সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ, রোগীর সংখ্যা কমাতে না পারলে হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা যতই বাড়ানো হোক কাজ হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ সময় প্রান্তিক মানুষদের জন্য সহায়তা সবচেয়ে জরুরি। কারণ প্রান্তিক মানুষদের ঘরে থাকতে হলে তাদের দৈনন্দিন খাদ্যের জোগান দেওয়াটা জরুরি। এ জোগান দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে সরকার ও সামাজিক শক্তিকে। তা না হলে স্বাস্থ্যবিধি অকার্যকর হয়ে পড়বে।’ 

পিএসডি/এসকেডি/জেএস