প্রায় ১০০ বছরের পুরনো একটি আইনে গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে আছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করে আলোচিত সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ৮ বছর বয়সী মেয়েটা এখনও জানে না কী কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তার মা।  

মেয়েটা জানে তার মা এখন ঢাকার বাইরে আছেন। মা তার সত্যিই ঢাকার বাইরে আছেন, কাশিমপুর কারাগারে। মেয়েটা জানে মা আছেন অফিসের কাজে। এক অর্থে সেটাও সত্য। নিজের প্রতিবেদন সংক্রান্ত কাজে সচিবালয়ে গিয়েই এখন প্রায় ১০০ বছরের পুরনো একটি আইনে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে তিনি।

রোজিনার পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মা ছাড়া থাকতে পারে না মেয়েটি। রোজিনাও একই। মেয়ের একাকীত্ব দূর করতে তাদের পরিবারের সবাই এক জায়গায় থাকছেন।

সাংবাদিক রোজিনার বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়া মোবাইল ফোনে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথির ছবি তোলা এবং আরও কিছু নথি লুকিয়ে রাখার অভিযোগ এনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। 

পরিবার জানায়, রোজিনার বিষয়ে জানতে মেয়েকে মোবাইল ও টিভি দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার পর একবার মেয়ের সঙ্গে কথা বলানো হয় রোজিনাকে। এ পাশ থেকে মেয়ে জানতে চাইল, আম্মু তুমি কোথায়, কবে আসবে? রোজিনা ইসলাম বলেন, আম্মু, তুমি চিন্তা করো না। আমি একটু কাজে ঢাকার বাইরে এসেছি। অফিসের কাজে এসেছি। কাজ শেষ করেই চলে আসবো।’

ঢাকা পোস্টকে এসব কথা বলেন রোজিনার বড় ভাই মো. সেলিম। তিনি বলেন, একমাত্র মেয়েটি রোজিনাকে ছাড়া কোনোভাবেই থাকতে পারে না। মেয়েকে রোজিনার কারাগারে যাওয়ার বিষয়টি বলা হয়নি। সোমবার রাত ও মঙ্গলবার সারাদিন পরিবারের সবাইকে মেয়েটি একই কথা বলতে থাকে, আম্মু কোথায়, আম্মু কবে আসবে? আমরা কোনোমতে তাকে বুঝ দিয়ে রেখেছি।

তিনি বলেন, আমার ভাগ্নি (রোজিনার মেয়ে) যাতে একা হয়ে না যায়, তার মাকে মিস না করে সেজন্য তার মামি, মামাতো ভাই-বোন, বাবাসহ পরিবারের সবাই একসঙ্গে আছি। আমরা পরিবারে একটি আনন্দঘন পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছি, যাতে মেয়েটা আপাতত তার মায়ের কথা মনে না করে।

প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল রাতে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি শুধু এইটুকু বলব, এ রকম একটি ঘটনায় সরকার ও সাংবাদিকদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হোক—এ রকম কোনো সন্দেহ যদি থাকে, তাহলে সরকার সেটি দূর করার চেষ্টা করবে।’

রোজিনার ছোট বোন সাবিনা ইয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মেয়েটি আমাদের কাছেই আছে। শুধু মায়ের কথা বলে। আমরা তাকে রোজিনার কারাগারে যাওয়ার কথা বলিনি। তাকে কোনোমতে বুঝিয়ে রাখা হচ্ছে।’

সোমবার (১৭ মে) পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে ফাইল চুরির অভিযোগ তুলে ৫ ঘণ্টার বেশি সময় তাকে আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাত ৯টার দিকে তাকে সচিবালয় থেকে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়। 

সোমবার রাতে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ উসমানী এ মামলা দায়ের করেন। রোজিনার বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়া মোবাইল ফোনে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথির ছবি তোলা এবং আরও কিছু নথি লুকিয়ে রাখার অভিযোগ এনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

সোমবার রাতে রোজিনা ইসলামকে শাহবাগ থানায় নেওয়ার পর সেখানে বিক্ষোভ দেখান সাংবাদিকরা

এরপর ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে মঙ্গলবার সিএমএম আদালতে তোলা হয় এই সাংবাদিককে। শুনানি শেষে রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। বৃহস্পতিবার ২০ মে তার জামিন শুনানি হবে।

রোজিনাকে গ্রেফতার ও হেনস্থার প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা সোমবার সচিবালয় ও শাহবাগ থানার সামনে বিক্ষোভ করেন। ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরাও ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য রোজিনা ইসলামের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি আছে। এমন একজন সাংবাদিককে হেনস্তা করা অন্যায়, অনভিপ্রেত। কী কারণে তাকে আটকে রাখা হয়েছে বিষয়টির তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’ 

রোজিনা ইসলামের স্বামী মনিরুল ইসলাম মিন্টু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রোজিনা একজন সৎ সাংবাদিক। বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে সংবাদ করার জন্য এর আগেও তাকে একাধিকবার নাজেহাল হতে হয়েছিল। এটিও তেমন কোনো ঘটনা হতে পারে।’ 

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য রোজিনা ইসলাম কানাডিয়ান অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সিলেন্স ইন বাংলাদেশি জার্নালিজম (২০১১), টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার (২০১৫), পিআইবি ও দুদকের উদ্যোগে দুর্নীতি প্রতিরোধে গণমাধ্যম পুরস্কারসহ (২০১৪) বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন।

এআর/এনএফ