রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন ফলের দোকানে কিংবা মোড়ে মোড়ে ভ্যান গাড়িতে এখন চোখে পড়ছে পাকা আম। কিছু আম হলুদ, কিছু হালকা সবুজ, আবার কিছু উজ্জ্বল কমলা রঙের। দেখতে সুন্দর এবং কিছুটা পাকা আমের সুবাস পেয়ে অনেক ক্রেতা দাঁড়িয়ে যান দোকানের সামনে। কেউ হাতে তুলে নেন, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ কেমন দেখেন।

মৌসুমের আগেই এত সুন্দর আম? — ক্রেতার এমন কৌতূহলী প্রশ্নের জবাবে বিক্রেতারা বলেন, ‘মামা, একবার নিয়েই দেখেন, কড়া মিষ্টি হবে’। কিন্তু বাড়ি ফিরে আম কাটতেই স্বপ্ন ভাঙছে ক্রেতাদের। বাইরের রঙিন আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসছে অপরিপক্ব, শক্ত, ফ্যাকাশে আর টক কিংবা পানসে স্বাদের আম। চকচকে রূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই প্রতারণার গল্প এ বছরের আগাম আমের।

সম্প্রতি রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর, উত্তরা, খিলক্ষেত ও নিউমার্কেট ঘুরে দেখা গেছে সবখানেই এখন অপরিপক্ব আমে ভরে গেছে বাজার। বিভিন্ন জাতের আকর্ষণীয় সব নামে বিক্রি হওয়া এসব আমের আসল স্বাদ মিলছে না। অধিকাংশ দোকানগুলোতে কাটিমন, গোপালভোগ জাতের আমের পরিমাণ বেশি। আকার আকৃতিভেদে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। একটু ফ্রেশ ও আকারে বড় কাটিমন আম বিক্রি করা হচ্ছে ১৬০ টাকায়। একই জাতের কিছুটা ছোট আকৃতির আম বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৫০ টাকায়। আর গোপালভোগ মান ও আকৃতি ভেদে ১৩০-১৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

দোকানিরা বলছেন, এগুলো আগাম জাতের আম। কেউ কেউ অবশ্য স্বীকার করছেন, লাভের আশায় কাঁচা আম পেড়ে রাসায়নিক প্রয়োগ করে পাকানো হয়েছে। আবার অনেক বিক্রেতা জানান, খরা পরিস্থিতি, কালবৈশাখী ঝড় কিংবা দমকা বাতাসে যেসব আম ঝরে পড়ছে সেসব আম বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পাকানোর পর বাজারে ছাড়া হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আম ব্যবসায়ী বলেন, অনেকে ইচ্ছা করেই অপরিপক্ব আম বাজারে আনছেন। এখন দাম অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। মৌসুম শুরু হলে দাম ১০০ টাকার নিচে চলে আসে। এখন দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা যাচ্ছে। অপেক্ষা করলে লাভ কমে যায়। তাই হয়ত আগেই পেড়ে রাসায়নিক দিয়ে পাকানো হয়। আমাদের দোষ দিয়ে লাভ নাই। কারণ, আমরা পাইকারদের কাছ থেকে আম সংগ্রহ করি। তারা যদি এখন আম না আনে তবে খুচরা বাজারেও আসবে না।

অন্যদিকে, যেসব ক্রেতা আম কিনছেন তারা বলছেন, আমের বাইরের রং ঠিক থাকলেও ভেতরে মিষ্টি স্বাদ এখনো তৈরি হয়নি।

নুরুল ইসলাম নামে এক ক্রেতা বলেন, বাইরে দেখে মনে হলো একেবারে পাকা। সেজন্য কিনলামও দাম দিয়ে। কিন্তু কেটে দেখি, ভেতরে কিছু হয়নি। পুরো টাকাটাই নষ্ট হয়েছে। বাইরে দিয়ে দেখতে সুন্দর, কিন্তু মিষ্টির ছিটেফোঁটাও নেই।

নূরজাহান পারভীন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, গত সপ্তাহে ১ কেজি গোপালভোগ ১৮০ টাকায় কিনেছি। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিল একেবারে পাকা। খাওয়ার সময় দেখি একদমই মিষ্টি না, বরং টক।

‘রাসায়নিক’ ম্যাজিকে পাকছে অপরিপক্ব আম

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিকভাবে বা স্বাভাবিক নিয়মে একটি আম পাকতে সময় লাগে ১৫ থেকে ৩০ দিন। গাছের পুষ্টি ও রোদ-বৃষ্টির সহায়তায় ফলের মধ্যে গ্লুকোজ, সুগার ও স্বাদের উপাদান তৈরি হয়। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয় মিষ্টি স্বাদ, মোলায়েম ত্বক আর ঘ্রাণ। এর বিপরীতে অপরিপক্ব আম পাকাতে ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক। এর মধ্যে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং সাম্প্রতিককালে ইথিফন নামের রাসায়নিক। যা তৈরি করছে পাকস্থলী ও অন্ত্রের জটিল রোগ, স্নায়ুতন্ত্র সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ও ক্যানসারের ঝুঁকি।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিটি ফলেরই একটি পরিপক্কতার সময় রয়েছে। যা দেখে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করতে হয়। এজন্য সরকার এবং কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন এলাকার জন্য বিভিন্ন জাতের আমের ক্ষেত্রে সংগ্রহের সময়সীমা দিয়ে থাকে। আবহাওয়ার ভিন্নতার কারণে এই সময়সীমা কিছুটা আগে-পরে হতে পারে। কিন্তু এখন আপনি আমের যে বর্ণনা দিচ্ছেন এতে বোঝা যাচ্ছে সেটি পরিপক্ব নয়। হয়তো কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করে আমগুলোকে হলুদ কালার করা হয়েছে, নরম করা হয়েছে। কারণ কোনো আম যখন বাইরে পরিপক্ব হবে তা অবশ্যই ভেতরেও পরিপক্ব হবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভেতরে যখন অপরিপক্ব হবে আর বাইরে পরিপক্ব কালার চলে আসবে সেটি স্বাভাবিক নয়।

তিনি বলেন, অপরিপক্ব আম পাকাতে তারা কোন রাসায়নিক ব্যবহার করছে এবং সেটি অনুমোদিত কি না অথবা সেই রাসায়নিকের অবশিষ্ট অংশ ফলে আছে কি না এসব দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়গুলো যখন আপনি কোনো বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করবেন তারা বলবে, আমরা কিছুই ব্যবহার করিনি এবং কিছুই জানি না। একজন আরেকজনকে দেখিয়ে দেবে। আড়তে কিংবা অন্যান্য জায়গায় তারা কী মেডিসিন ব্যবহার করছে সেগুলো সামনে আসা দরকার। 

এক্ষেত্রে ভোক্তাদের সচেতনতাও জরুরি উল্লেখ করে অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক বলেন, এসব বিষয়ে আমাদের ভোক্তাদের সচেতনতা খুবই জরুরি। এর সাথে রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে। বিশেষ করে ভোক্তার জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো দেখতে পারে। একইসঙ্গে উৎপাদক, বাজারজাতকারকসহ সংশ্লিষ্ট সবারও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। তাদের অতি লাভের অসৎ প্রবণতা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।

আরএইচটি/এমএ