অসাধারণ সাফল্য সত্ত্বেও লোকবল, ইক্যুইপমেন্ট এবং অর্থের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি অপারেশনাল গাড়ি নেই কোনো-কোনো জেলায়। রয়েছে নানা কাঠামোগত ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ। যার ফলে তদন্তের গতি মন্থর এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করাও সিআইডির জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। এর মধ্যে অনিয়মিত বদলির আতঙ্ক নিবেদিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি করেছে।

দক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়নে সীমাবদ্ধতা, মাঠপর্যায়ে ফরেনসিক ল্যাব না থাকায় অনেক সময় প্রয়োজনীয় আলামত বিশ্লেষণ বিলম্বিত হচ্ছে বলেও জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ(সিআইডি)।

পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫ উপলক্ষ্যে বুধবার (৩০ এপ্রিল) দ্বিতীয় দিনে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপনায় নিয়মিত কার্যক্রমের ফিরিস্তি তুলে ধরার পাশাপাশি সিআইডির সীমাবদ্ধতা ও সমস্যাগুলো ধরে হয়। তুলে ধরা হয় ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত নানা কার্যক্রম, সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও।

রাজধানীর রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে সিআইডি প্রধান অ্যাডিশনাল আইজি (ভারপ্রাপ্ত) গাজী জসীম প্রেজেন্টশন উপস্থাপনা করেন। তিনি বলেন, একবিংশ শতাব্দীর জটিল অপরাধসমূহ মোকাবিলায় সিআইডি এখন আরও আধুনিক, প্রযুক্তনির্ভর কার্যক্রমের দ্বারা অপরাধ তদন্ত ও তদন্ত সহায়ক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

সিআইডি সূত্র এবং ওই প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, জুলাই ২০২৪-এর রাজনৈতিক অভ্যুত্থান পরবর্তী অনুসন্ধানের জন্য সিআইডি গঠন করেছে বিশেষ তদন্ত কমিটি। সাবেক মন্ত্রী ও সমাজে প্রভাবশালীদের সন্দেহজনক সম্পদের উৎস ও প্রকৃতি নিয়ে নিবিড় অনুসন্ধান চালানো হয়। এছাড়াও এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, নাবিল, ইউনিক, সিকদার গ্রুপসহ একাধিক বড় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ও অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধানকালীন প্রায় ৫ হাজার ৮০০ শতাংশ জমি ও হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ শনাক্ত করা হয়েছে।

ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিটের কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য যাচাই-বাছাই কমিটি বিভিন্ন উৎস যথা- বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ব্যাংক), মেট্রোপলিটন ও জেলা পুলিশ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ও অন্যান্য ইউনিট, সিআইডি জেলা ইউনিট, গণমাধ্যম (পত্রিকা, অনলাইন, পোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি) হতে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার, ও অবৈধ সম্পদ অর্জন ইত্যাদির উপর অনুসন্ধান পরিচালনা করে।

স্বর্ণ চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ধারা কেনা জমি, বাড়ি, হোটেল ও গাড়ি চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী ক্রোক করা চলমান রয়েছে। রাজধানীর বাড্ডা, যশোর, লালমনিরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় বহু মামলা রুজু হয়েছে এবং এসব মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফে একটি মামলায় প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ (২৯৫ শতাংশ জমি, বাড়ি, পাঁচটি প্রাইভেটকার) জব্দ করা হয়।

অপরাধ বিশ্লেষণের নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে ফরেনসিক শাখা দিনে দিনে পরিণত হচ্ছে উল্লেখ করে সিআইডির প্রধান তার উপস্থাপনায় বলেন, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক ফরেনসিক প্রতিবেদন আপাত ক্লু-লেস মামলার রহস্য উদঘাটনে ভূমিকা রেখে চলেছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্তকরণ, ডিএনএ ল্যাব, ডিজিটাল ফরেনসিক ও কেমিক্যাল ল্যাব-এই চারটি ল্যাব অপরাধ বিশ্লেষণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। শত-শত মামলার আলামত পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অপরাধীদের শনাক্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি চাঁদপুরের মেঘনায় ৭ খুন, ঝালকাঠিতে যুবক হত্যা, বাড্ডায় চুরি প্রতিটি ঘটনার রহস্য উদঘাটনে সিআইডির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ভূমিকা রেখেছে।

বর্তমান যুগের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ সাইবার ক্রাইম মোকাবিলায় সিআইডির অগ্রণী ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরে উপস্থাপনায় বলা হয়, সংস্থাটির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) এই অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয়। আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্য গ্রেপ্তার, বাংলাদেশি হ্যাকার কর্তৃক নেপালি কিশোরীদের ব্ল্যাকমেইল, ইভেন্ট কোম্পানির ওয়েবসাইট হ্যাক ও গ্রাহকদের তথ্য ফাঁস, আতিফ আসলামের কনসার্টের টিকিট জালিয়াতি ও ডেটা চুরির মতো আলোচিত ঘটনার রহস্য উদঘাটনের পাশাপাশি ফেসবুক ও ইউটিউবের সাথে সমন্বয়ে বিভ্রান্তিকর পোস্ট বা প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব দমনে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছে।

তিনি নানা সীমাবদ্ধতার বিষয় তুলে ধরে সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপের আহ্বান জানান।

অফিস-অপারেশনাল গাড়ির সংকটে তদন্তে ধীরগতি

অসাধারণ সাফল্য সত্ত্বেও লোকবল, ইক্যুইপমেন্ট এবং অর্থের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি সিআইডিতে রয়েছে নানা কাঠামোগত ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ, যা তদন্তের গতি মন্থর করে বা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করাও কষ্টসাধ্য হয়। প্রথমত যানবাহনের সংকট যেমন- দেশের বিভিন্ন ইউনিটে যানবাহনের অপ্রতুলতা, কোনো কোনো জেলা ইউনিটে একটিও অপারেশনাল গাড়ি নেই। নিজস্ব স্থাপনায় অফিসের অভাব রয়েছে। সারা দেশে সিআইডির অধিকাংশ ইউনিটের অফিসই ভাড়া অফিস অথবা জেলা এসপি অফিসের ওপর পরিচালিত হয়।

প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, আছে বদলি নিয়ে হতাশা

অনুষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, সিআইডিতে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব ও বদলি নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যেকার হতাশার বিষয়টিও সভায় উঠে এসেছে। প্রশিক্ষণের অভাবে কর্মকর্তাদের দক্ষতার ঘাটতি হচ্ছে। এছাড়াও অনিয়মিত বদলির আতঙ্ক নিবেদিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি করে। দক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়নে সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।

মাঠপর্যায়ে ফরেনসিক ল্যাব চায় সিআইডি

পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিটের মাঠপর্যায়ে নেই কোনো ফরেনসিক ল্যাব। মাঠপর্যায়ে ফরেনসিক ল্যাব না থাকায় অনেক সময় প্রয়োজনীয় আলামত বিশ্লেষণ বিলম্বিত হয়। এজন্য প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরসহ গুরুত্ব অনুযায়ী বড়-বড় জেলা শহরগুলোতে আলাদা ফরেনসিক ল্যাব স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দসহ প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম চায় সিআইডি

সাইবার পুলিশ সেন্টারে (সিপিসি) রয়েছে প্রযুক্তিগত সরঞ্জামের অভাব। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাইবার টুলস ও সফটওয়্যারের অভাব পরিলক্ষিত হয়। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যুগোপযোগী প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ফরেনসিক ল্যাবে রয়েছে সফটওয়‍্যারের জন্য উপযুক্ত বাজেটের স্বল্পতা।

সিআইডি প্রধান অ্যাডিশনাল আইজি (ভারপ্রাপ্ত) প্রধান গাজী জসীম বলেন, সিআইডি এখন শুধু একটি তদন্ত সংস্থা নয় বরং নতুন বাংলাদেশে আইন ও বিচার ব্যবস্থায় প্রযুক্তির মেরুদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সিআইডি বিদ্যমান প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে অপরাধ দমনে কার্যকর প্রভাবক হিসেবে দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।

জেইউ/এমজে