আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশে দিবসটি জাতীয়ভাবে পালন করা হয় ‘জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান’ নামে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার’ এবং স্লোগান রাখা হয়েছে ‘প্রকৃতি সংরক্ষণ করি, প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করি’। অন্যদিকে জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান-২০২১ সালের প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষে অঙ্গীকার করি, সোনার বাংলা সবুজ করি’।

বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো দিবসটি সারা বিশ্বের মতো যথাযথ মর্যাদায় পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। দিনটিতে তারা বৃক্ষরোপণ, র‌্যালি, আলোচনা অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকলে আগামী প্রজন্ম সুস্থভাবে বাঁচতে পারবে- এমনটাই প্রত্যাশা করছেন পরিবেশবিদরা। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

পরিবেশ দিবসের ইতিহাস

সুইডেন সরকার ১৯৬৮ সালের ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। ওই চিঠির বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা। সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরের বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের প্রথম পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। 

আরও পড়ুন: অভিজাত মলে নয়, পুরো পৃথিবীটাই হোক অক্সিজেন বার

এদিকে বাংলাদেশে দিবসটি ১৯৭২ সাল থেকে ‘জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর ১০০টিরও বেশি দেশে দিবসটি পালন করা হয়।

দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, মানব সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষায় প্রতিবেশ-সংরক্ষণ এবং অবক্ষয়িত পরিবেশ পুনরুদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবেশ-ধ্বংসকারী কার্যক্রম যেমন বন-জঙ্গল ধ্বংস করা, বন্যপ্রাণী নিধন এবং বায়ুদূষণসহ অন্যান্য দূষণ বৃদ্ধির প্রভাবে জলবায়ু-পরিবর্তনের ফলে আজ মানবজাতির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।

তিনি আরও বলেছেন, ‘সরকার জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশগুলোকে সংরক্ষিত এলাকা ও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণাপূর্বক সেগুলোর প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবক্ষেত্রে যাতে পরিবেশগত টেকসই উন্নয়নকে বিবেচনায় নেওয়া হয়, সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান-স্থাপনে প্রতিবেশ ও পরিবেশসম্মত বিধিব্যবস্থা-প্রতিপালনের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে কৃষি, শিল্পসহ সবক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।’

বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের কারণে মানবজাতি ও অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রকৃতি যেন কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সারাবিশ্বে একসঙ্গে ‘লকডাউন’ হওয়ায় পরিবেশ দূষণ কমেছে, পৃথিবী একটি গাঢ় সবুজ গ্রহে পরিণত হয়েছে। এই মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ একটি সবুজ-পৃথিবী সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করবে বলে আমার বিশ্বাস।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল রক্ষাকারী ঝাউবেষ্টনী সৃষ্টি করেছিলেন। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে জানমালের সুরক্ষা দিতে বেড়িবাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও মুজিবকিল্লা নির্মাণ করেছিলেন এবং স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ কৃষক লীগ ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতিবছর আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র এই তিন মাস সারা দেশে ফলজ, বনজ ও ভেষজ এ তিন প্রজাতির গাছ লাগানোর কর্মসূচি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করছে। আমরা পরিবেশ বিপর্যয়ে সংকটাপন্ন দেশগুলোর স্বার্থ-সুরক্ষায় ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ)’ এবং ‘ভালনারেবল-২০ এর অর্থমন্ত্রীদের জোটের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমরা জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করছি। জলবায়ুর-পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে টেকসই উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ-ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ বাস্তবায়ন করছি। আমরা জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই এক কোটি গাছের চারা রোপণ করেছি। উন্নত দেশগুলোর লাগামহীন উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা ও শিল্পায়নের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রার ক্রমাগত বৃদ্ধি জলবায়ু-পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। জলবায়ু-পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।’

পরিবেশ দিবস উপলক্ষে এক প্রবন্ধে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন বলেছেন, বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হুমকির সম্মুখীন। জাতিসংঘের তথ্য মতে, প্রকৃতি ধ্বংসের বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে হচ্ছে, তা যদি চলতে থাকে তাহলে ২০৭০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি তিনটির মধ্যে একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। গত ৫০ বছরে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি বন্যপ্রাণী হ্রাস পেয়েছে। সে হিসেবে গত ১০ মিলিয়ন বছরের তুলনায় বর্তমানে প্রজাতি বিলুপ্তির গড় হার ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। পৃথিবীব্যাপী বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভগুলো মনুষ্য কর্মকাণ্ডে অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ ভূ-ভাগে মানুষ ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন করেছে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক প্রতিবেশ আজ পরিবেশগত হুমকির সম্মুখীন। ২০১০ হতে ২০১৫ সালের মধ্যে ৩২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। আমরা যদি পরিবেশগত এ অবক্ষয় রোধ করতে না পারি তাহলে ব্যাপকভাবে জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ ধ্বংসের কারণে মানুষের খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, পরিবেশ দিবসের থিম করা হয়েছে জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার করার জন্য। কিন্তু আমরা পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ তো পরে নেব, বন্ধই করতে পারছি না। বরং জীববৈচিত্র্য যেসব কাজে ধ্বংস হতে পারে আমরা সেইসব কাজে মনোযোগী হয়েছি। কাজেই আমাদের মাইন্ডসেটে পরিবর্তন আনতে হবে। বাজেটে এটার প্রভাবও আছে। এবার বাজেটে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের টাকা কমে গেছে। এটার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের একার দোষ দিলে হবে না, পরিবেশ মন্ত্রণালয় খরচ করতে পারেনি। কম টাকা দেওয়া সমাধান নয়, সমাধান হচ্ছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। যাতে তারা যেটা করা দরকার, সেটা এনশিওর করতে পারে। এটার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আরও বেশি এফোর্ড দিতে হবে।

পরিবেশ দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি

বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে শনিবার (৫ জুন) জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান-২০২১ এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকাল ১১টায় তিনি গণভবনে সোনালু, জাম, আমড়া ও ডুমুর বৃক্ষের চারটি চারা রোপণ করে জাতীয় এই বৃক্ষরোপণ অভিযান-২০২১ এর উদ্বোধন করবেন। এসময় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার এবং সচিব জিয়াউল হাসানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ‘তরুণ প্রজন্মের হাতেই প্রকৃতি ও পরিবেশের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক একটি অনলাইন আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এটি সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে।

এছাড়া পরিবেশবাদী যুব সংগঠন গ্রীন ভয়েস বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বৃক্ষরোপণ, র‌্যালি ও সেমিনারের আয়োজন করেছে। সকাল ৯টায় সোহরায়ার্দী উদ্যানে ১০০টি ফলদ ও বনজ বৃক্ষরোপণ করা হবে। পরে একটি র‌্যালি টিএসসি থেকে শাহবাগে এসে শেষ হবে। এরপর ‘জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে তরুণ সমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে বাপার সভাপতি এড. সুলতানা কামাল, বেলার পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, অধ্যাপক এম এম আকাশ প্রমুখ উপস্থিত থাকার কথা আছে।

এমএইচএন/এসএসএইচ