রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক সাবিরা রহমান লিপি হত্যাকাণ্ডের ৫ দিন পার হলেও খুনি কে? কেনইবা খুন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো ক্লু পাচ্ছে না পুলিশ। নানা প্রশ্ন সামনে উত্থাপিত হলেও না মিলছে উত্তর, না খুলছে তদন্তের জট। সাবিরা হত্যা মামলার তদন্ত এখন অনেকটা গোলকধাঁধায় বন্দি।

ডাক্তার সাবিরা হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বাদী রেজাউল হাসান সাবলেটে থাকা তরুণী এ হত্যায় জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ পোষণ করলেও তাকেসহ হেফাজতে নেওয়া সবাইকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাক্তার সাবিরা হত্যার শিকার। হত্যার পর আগুন দিয়ে আলামত নষ্টের অপচেষ্টাও হয়েছে। এসবই স্পষ্ট। কিন্তু খুনি কে? কেন খুন, মিলছে না উত্তর।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) গোলাম রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বলার মতো অগ্রগতি নেই। তদন্ত চলছে। দেখা যাক, দোআ করেন।

শুক্রবার সন্ধ্যায় (৪ জুন) রমনা বিভাগের কলাবাগান জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সবাই চেষ্টা করছি। ক্লু মিলছে না। ওই ঘটনার আগে ও পরে সন্দেহভাজনদের ফোনকল যাচাই করা হচ্ছে। নিহতের মোবাইল ফোনের ফরেনসিক ও কল লিস্ট খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এ ঘটনায় সাবলেট থাকা তরুণীসহ পুলিশ হেফাজতে থাকা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এখন পর্যন্ত স্পষ্টত কোনো ক্লু নেই, তাই কাউকেই পুলিশ সন্দেহের বাইরে রাখছে না। প্রয়োজন হলে যে কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

এর আগে সহকারী পুলিশ কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান জানিয়েছিলেন, কে কে নিহতের ভাড়া বাসায় যাতায়াত করতো, পরিবারের সঙ্গে নিহতের দূরত্ব, অপরিচিত কারো যাতায়াত ছিল কিনা তা জানার চেষ্টা চলছে। তবে এক্ষেত্রে নিহতের ভবন ও আশপাশে সিসিটিভি ফুটেজ না থাকায় সংগ্রহ করা হয় দূরবর্তী সিসিটিভি ফুটেজ। তবে তাতে কাঙ্খিত কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, আত্মীয়-স্বজনদের বক্তব্য ডাক্তার সাবিরা খুবই ভালো মানুষ, নামাজ পড়তেন নিয়মিত। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব ছিল। দেখা সাক্ষাৎ কম হতো। স্বামীর অবর্তমানে নিহতের বাসায় কারও যাতায়াত ছিল কিনা, কারও সঙ্গে বিশেষ ফোনালাপ হতো কিনা তাও যাচাই করা হচ্ছে।

ঘটনার দিনই সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট মরদেহের শরীরে, দরজায়, চেয়ারে একাধিক জনের ফ্রিঙ্গারপ্রিন্ট পায়। আলামতের মধ্যে ছিল সিগারেটের মোতা, সিঁড়ি থেকে ঠান্ডা কফির মগ।

এদিকে ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব-২ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একাধিক টিম। তবে এখন পর্যন্ত কারও তদন্তে খুনের ক্লু মেলেনি।

পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, পরকীয়া, ডাকাত চক্র, পারিবারিক দ্বন্দ্বকে গুরুত্ব দিয়ে ক্লু খোঁজা হচ্ছে। স্বামীর অবর্তমানে সাবিরার সময় কিভাবে কাটতো, ছেলেকে নিয়ে কেন তিনি সম্প্রতি কানাডায় পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন তার উত্তরও খোঁজা হচ্ছে।

সাবিরার খালাতো বোন জাকিয়া খন্দকার বলেন, গত জানুয়ারির শেষে ওই বাসায় উঠেছিল সাবিরা আপু। সে নামাজি ছিল। তার বাসায় বোনের মেয়ে ও সাবলেটের দুই তরুণী ছাড়া কারও বিশেষ যাতায়াত ছিল বলে শুনিনি। স্বামীর সঙ্গেও মনোমালিন্যও ছিল না। আপু কফি নয় চা খেতেন। তাই জব্দ কফির মগের ব্যবহারকারী বের হলে মিলতে পারে খুনির সন্ধানও।

৩১ মে (সোমবার) কলাবাগানের ৫০/১ ফার্স্ট লেনের ডাক্তার সাবিরার ভাড়া বাসায় প্রথমে আগুনের খবরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে যায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গিয়ে বাসায় আগুনের ধোঁয়া দেখতে পান। নিহত চিকিৎসকের শরীরের কিছু অংশ দগ্ধ ছিল বলে জানান তারা। মরদেহ উদ্ধারের পর পিঠে দুটি ও গলায় একটি ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পায় পুলিশ।

খবর পেয়ে সোমবার ঘটনাস্থলে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। আলামত সংগ্রহের পর ক্রাইম সিন ইউনিট জানায়, সাবিরাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা (ব্রুটালি কিলড) করা হয়েছে। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর বিছানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দাহ্য পদার্থ না থাকায় আগুন তেমন ছড়ায়নি। তবে, সাবিরার শরীরের কিছু অংশ এতে দগ্ধ হয়।

সেসময় সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের পরিদর্শক শেখ রাসেল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাবিরার শ্বাসনালী কেটে ফেলা হয়েছে। তার দেহে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও পোড়ার ক্ষত আছে। আমরা আপাতত নিশ্চিত হয়েছি, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। আলামত দেখে মনে হয়েছে, মধ্যরাতের যেকোনো সময় হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে।’

জেইউ/এসএম